দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে। প্রচণ্ড ঝড়ের আগে যেমন পুরো আকাশ থমথমে হয়ে থাকে, ঠিক তেমন অবস্থা যেন এখন বাংলাদেশের। আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কী হবে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করছেন। বিবিসিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এ তথ্য জানান। সন্ধ্যায় নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে যান। নাহিদ ইসলাম জুলাই গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক এবং যারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসাবে মনোনীত করেছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নাহিদ ইসলাম ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টামণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। যখন ছাত্ররা তাদের জুলাইয়ের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন তিনি পদত্যাগ করেন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গতকাল তার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। নাহিদ ইসলামের বরাত দিয়ে বিবিসি বলেছে, ‘প্রধান উপদেষ্টা হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং তিনি এই অবস্থায় পদত্যাগ করতে চান।’
বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে জানা গেছে যে বৃহস্পতিবার দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদে নিয়মিত বৈঠকের পর অনির্ধারিত আলোচনা শেষে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অন্য উপদেষ্টাদের সাথে কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে হতাশার কথা তুলে ধরেন তিনি।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন যে ঢাকায় প্রতিদিন সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কার সহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। আলোচনার এক পর্যায়ে ‘কাজ করতে না পারা’র বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেন, সংস্কারের বিষয়ে এখনও তেমন কিছু হলো না। তাহলে তিনি কেন থাকবেন।
বৃহস্পতিবার নাহিদ ইসলামের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আলাপের পর দুই ছাত্র উপদেষ্টাও প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করেন। এরা হলেন আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলম। এদের দুজনের কাছেও প্রধান উপদেষ্টা একই রকম মনোভাব ব্যক্ত করেছেন বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ এখন একটি গভীর সংকটে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের জাতির অভিভাবক। তিনি শুধু বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি নন, তিনি বিশ্ববরেণ্য একজন শান্তির দূত। বাংলাদেশকে এই সংকটের গভীরে রেখে তিনি পদত্যাগ করলে বাংলাদেশ হবে একটি পথহারা। বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধের মুখে ধাবিত হতে পারে। এরকম পরিস্থিতি নিশ্চয়ই তিনি চাইবেন না।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে, আছে দায়িত্ববোধ। আর এই দায়িত্ববোধ থেকেই এই বিচক্ষণ ব্যক্তি দেশকে এই সংকটের গভীরে রেখে জনগণকে আগ্নেয়গিরির সামনে রেখে সরে যাবেন না। আমরা প্রত্যাশা করি যে তিনি দায়িত্বশীল আচরণ করবেন এবং সকলে তাকে সহযোগিতা করবে। বর্তমান যে সংকট, তা থেকে উত্তরণের একটি মাত্র পথ, তা হলো নির্বাচন। যে কথাটি বারবার সাধারণ মানুষ বলছে এবং সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
গত বুধবার সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে সেনাপ্রধান গণতন্ত্র উত্তরণের একটি সুস্পষ্ট পথরেখা দিয়েছেন। যে পথরেখার মাধ্যমে সহজেই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। সেনাপ্রধান আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এই লক্ষ্য সামনে রেখে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। এটাই সংকট উত্তরণে একমাত্র পথ। প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি চাইলে মাত্র তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। অতীতের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকার গুলোই তিন মাসের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করেছিলেন। ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০১ আমাদের সামনে উদাহরণ। কাজেই প্রধান উপদেষ্টা পারবেন না কেন? তিনি নিশ্চয়ই পারবেন। আমার মনে হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকতে চাইবে, তত দাবিদাওয়া এবং নানারকম ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠবে, যা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। সবাই তার মতো করে সুবিধা আদায় করতে চাইবে। সবাই তার মতো তার অবস্থান পোক্ত করতে চাইবে। এরকম পরিস্থিতির ফলে দেশে অস্থিরতা আরও বাড়বে, বাড়বে অরাজকতা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার যদি দায়িত্ব গ্রহণ করেই দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচনের পথে যেতেন, তাহলে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। নির্বাচনের জন্য একটি জাতীয় ঐক্যমত, সংবিধান, নির্বাচন কমিশন সংস্কারের বিষয়গুলোর নিয়ে আলোচনা করে একটা সমাধানে আসতেন। শুধু প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নন, আপামর দেশের মানুষ এখন হতাশ, সকলেই এখন ক্ষুব্ধ। এরকম একটি বাস্তবতায় যদি প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন বা পদত্যাগের কথা ভাবেন তাহলে বাংলাদেশ একটি অন্ধকার টানেলে প্রবেশ করবে।
প্রধান উপদেষ্টা একজন লড়াকু মানুষ। তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে উজ্জ্বল করেছেন। তিনি জোবরা গ্রাম থেকে তিল তিল করে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। তিনি হাল ছেড়ে দেবেন- সেটা হতে পারে না। তিনি হাল ছেড়ে দিলে বাংলাদেশের সব ‘সম্ভাবনা’ বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশে এখন যে অস্থিরতা, হানাহানি, মারামারি চলছে তা আরও বেড়ে যাবে। এরকম অবস্থা আমরা চাই না। আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমরা আশা করি যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এদেশের মানুষকে আশাহত করবেন না। পদত্যাগ নয়, আশা করি ড. ইউনূস নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে আর কালবিলম্ব করবেন না। একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে এসব অস্থিরতা থেকে দেশ মুক্তি পাবে।
আমরা গত নয় মাসে অনেক উপদেষ্টা সম্পর্কে নানা রকম কথাবার্তা শুনেছি, দেখেছি। যত সময় যাবে এই বিতর্কগুলো বাড়তে থাকবে। ইতিমধ্যে বিএনপি তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপিও তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছে। উপদেষ্টামণ্ডলীদের অর্ধেকেই এখন নানা ভাবে বিতর্কিত। দিন যত যাবে, তত পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকবে। মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ বাড়তে থাকবে।
সেজন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই, আমাদেরকে সমাধান বের করতে হবে। বাংলাদেশের সামনে সমাধান এখন একটাই। নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। সশস্ত্র বাহিনীর যে প্রত্যাশা, জনগণের যে অভিপ্রায় সেই অভিপ্রায়ের একাত্ম হয়ে সাথে মিলিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অবিলম্বে একটি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন, এটাই জনগণ প্রত্যাশা। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপক্ষে এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে, বাংলাদেশ যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশের সামনে একটি অপূর্ব অনবদ্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগকে পূর্ণতা দিতে পারেন একমাত্র আপনি। আপনি পদত্যাগ করলে সেই সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি অনেক কিছু সৃষ্টি করছেন। বাংলাদেশকে একটি শান্তির বন্দরে আপনিই নিয়ে যেতে পারেন। আপনি জাতির অভিভাবক। আপনার উপর জনগণের প্রত্যাশা অনেক। কাজেই আপনি এখন পদত্যাগ করতে পারেন না।
পদত্যাগ কোন সমাধান নয়, বরং আপনাকে দৃঢ় হাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। সশস্ত্র বাহিনী আপনার পাশে আছে। জনগণ আপনার পাশে আছে। আপনাকে কী করতে হবে তা আপনি আমাদের চেয়ে ভালো জানেন। তারপরও সাধারণ মানুষ মনে করে এই মুহূর্তে আপনার করণীয় কাজ তিনটি।
প্রথমত, সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অবিলম্বে একটি সর্বদলীয় বৈঠক করা। দ্বিতীয়ত, জুলাই বিপ্লবের যে সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত, সেই সব বিষয়গুলোতে একটি সর্বদলীয় চুক্তি স্বাক্ষর করা। তৃতীয়ত, অবিলম্বে নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারে’ রূপান্তর করা।
আমার মনে হয়, জনগণ বিশ্বাস করে এরকম একটা সিদ্ধান্ত যত দ্রুত আপনি নেবেন, তত দ্রুত দেশ সংকট থেকে মুক্তি পাবে। এই অস্থিরতা, হানাহানি বন্ধ হবে। না হলে আপনাকে হতাশ হতে হবে। জাতিকেও হতাশ হতে হবে।
বাংলাদেশে অভিভাবকতুল্য মানুষের সংখ্যা খুব কম। এরকম খুব কম মানুষ আছেন, যাদেরকে সবাই সম্মান করে, ভাবে শ্রদ্ধা করে। আপনি তাদের একজন। কাজেই আপনার কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। আপনি মাঝপথে বাংলাদেশকে পথহারা করে ছেড়ে যাবেন না। আপনি সকলের সাথে বসুন। নির্বাচন দিন। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় আপনি হোন পথ প্রদর্শক।
নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল: [email protected]