রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে ছিল। মাঠে ও কলকারখানায় উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ক্রেতারা ছিল দিশাহারা। চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিক গতিতে। মানুষের কর্মসংস্থান কম। বেকারত্ব বেশি। সংসার চালাতে অনেকের ছিল ত্রাহি অবস্থা। ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে অনেক মানুষ।
জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে চতুর্থ। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় নিমগ্ন অন্য চারটি দেশ হচ্ছে নাইজেরিয়া, সুদান, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও ইথিওপিয়া। সমীক্ষা পরিচালনায় অংশগ্রহণকারী সংস্থাগুলো হলো এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফ। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট নিয়ে করা ওই সমীক্ষা প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অব ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ অনুসারে বাংলাদেশের সাত কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না। দেশের ১০ শতাংশের বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার। তারা সুষম খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। দেশের দৃশ্যমান খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় জাতিসংঘের ওই সমীক্ষার ফলাফল আমাদের শঙ্কিত করে। তাতে চিন্তার উদ্রেক ঘটায়।
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত আছে। প্রথমটি খাদ্যের গড় প্রাপ্যতা, দ্বিতীয়টি খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবার অভিগম্যতা এবং তৃতীয়টি খাদ্যের পর্যাপ্ততা, সুষমতা ও নিরাপদতা। অনেকে এগুলোকে তিনটি ‘এ’ (এভেইলেবিলিটি, এক্সেস এবং এডিকুয়েসি) হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খরা ও বন্যায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে প্রয়োজনীয় প্রাপ্যতায় ঘাটতি ছিল। তবে ব্যাপক মাত্রায় চাল ও গম আমদানি করে (১৪.৩৭ লাখ টন চাল ও ৬২.৩৫ লাখ টন গম মোট ৭৬.৭২ লাখ টন খাদ্যশস্য) মোট প্রাপ্যতা বৃদ্ধির প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যশস্যে সবার অভিগম্যতা ছিল না।
সরকারের গরিববান্ধব কর্মসূচির আওতা হ্রাসের কারণেও অভিগম্যতা হ্রাস পায়। খাদ্যপ্রাপ্তিতে পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অনেক ঘাটতি আছে। সুষম খাদ্যের সরবরাহ সীমিত। প্রাপ্য খাদ্যের নিরাপদতা নিয়েও রয়েছে অনেক শঙ্কা। তবে বর্তমান অর্থবছরের শুরুতে খাদ্যশস্যের মোট সরবরাহ অনেকটা ভালো বলে প্রতীয়মান। গত বোরো মৌসুমে চালের মোট উৎপাদন ভালো হয়েছে। চাল ও গম মিলে ৩ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের মজুদ রয়েছে ২১ লাখ ৩১ হাজার টন। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে খাদ্যশস্যের বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠছে। তাতে খাদ্যের অভিগম্যতা থেকে সাধারণ ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় সাম্প্রতিক ঘাটতি থাকার অন্যতম কারণ মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৬৩ শতাংশ। সেটা ছিল গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪.১ শতাংশ। এরপর গত নভেম্বর মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৩৮ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩.৮ শতাংশ। গত জুন মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮.৪৮ শতাংশে নেমে আসে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস পায় ৭.৩৯ শতাংশে। গত রবি মৌসুমে শাক-সবজি, আলু, পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন পর্যাপ্ত হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস ধরে ক্রমাগতহারে নেমে আসে। তাতে সাধারণ মূল্যস্ফীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে অতি সম্প্রতি চালের মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য যেমন মাছ, মাংস, সবজি ও পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধির শঙ্কা জেগেছে। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৫৬ শতাংশে। বাংলাদেশের মতো একটি কম গড় আয়ের দেশে এ মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। এ হার ২/৩ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকা উচিত।
আমাদের দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় প্রভাব রাখে চাল ও মাছের মূল্যবৃদ্ধি। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চাল ও মাছ মিলে মোট ৮৩ শতাংশ অবদান রাখে। চাল একাই অবদান রাখে ৫০.৭৬ শতাংশ। তন্মধ্যে মাঝারি চালের অবদান ২৫.১৭ শতাংশ এবং মোটা চালের অবদান ১৭.৬৭ শতাংশ, বাকি সরু চাল। অন্যদিকে মাছের ভূমিকা ৩২.৩৭ শতাংশ। অতএব চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা খাদ্য মূল্যস্ফীতি দমনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে চালের বাজারে যে অস্থিরতা চলছে তা সামাল দিতে প্রায় ৯ লাখ টন চাল আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তন্মধ্যে চার লাখ টন সরকারিভাবে এবং পাঁচ লাখ টন বেসরকারিভাবে আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববাজারে এখন চালের দাম সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ সময় সরকারি পর্যায়ে চালের আমদানি বেশি হলে এবং তা খোলাবাজারে বিক্রি করা হলে অভ্যন্তরীণ চালের দামে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গত নভেম্বর মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত খাদ্য মূল্যস্ফীতি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাতে হ্রাস পেয়েছে সাধারণ মূল্যস্ফীতি। এর সঙ্গে দেশের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশে ধরে রেখেছে। চলতি জুলাই-ডিসেম্বর প্রান্তিকের মুুদ্রানীতিতে ও সংকোচনমূলক ধারা অব্যাহত রয়েছে। তা ছাড়া টাকার নিম্নমুখী বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক বাজারে পণ্যমূল্যের নিম্নমুখী প্রবণতা মূল্যস্ফীতিকে অবদমিত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায় মূলত সরবরাহ সংকটের কারণে। উপকরণ মূল্য বাড়ার কারণেও পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এটিকে বলা হয় উৎপাদন খরচতাড়িত মূল্যস্ফীতি। এর সঙ্গে অধুনা যুক্ত করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের লোভতাড়িত তথা অযাচিত মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশাজনিত মূল্যবৃদ্ধিকে। পণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হ্রাস পেলে এবং বৈশ্বিক মুদ্রা সংকটের কারণে আমদানি কম হলে বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। প্রায় তিন বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে উল্লিখিত কারণগুলো বিদ্যমান ছিল। এ সময় কৃষি উপকরণ বিশেষ করে সার, শ্রমিক ও সেচের দাম লাগাতার বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়ার বৈপরীত্য বিঘ্নিত করেছে উৎপাদন, সৃষ্টি হয়েছে পণ্যের সরবরাহ সংকট। এ সুযোগে এক শ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন।
আমাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একটা বড় কারণ উৎপাদনে অদক্ষতা। ফসল কৃষি খাতে যেমন অদক্ষতার অনেক দৃষ্টান্ত আছে, শস্যবহির্ভূত কৃষি খাতেও তার দৃষ্টান্ত কম নয়। দেশে মাছ, মাংস, ডিমের উৎপাদন অনেক বেড়েছে, কিন্তু দাম চড়া। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে আমিষজাতীয় খাদ্যের দাম বেশি। অনেক সময় তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে। তাতে সুষম খাদ্যপ্রাপ্তির সুযোগ থেকে অনেক ভোক্তা থাকে বঞ্চিত। নতুন প্রযুক্তি ধারণ ও উৎপাদনপ্রক্রিয়া বাণিজ্যিকায়নের প্রধান উদ্দেশ্য হলো অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ভোক্তাদের কাছে পণ্যসামগ্রী সহজলভ্য করা। কিন্তু সে উদ্দেশ্য অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে। তার প্রতিকারের জন্য উৎপাদনের অদক্ষতা দূর করতে হবে। তাতে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে। সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে পণ্যমূল্য।
গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ০.০৭ শতাংশ বেড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ০.১৭ শতাংশ। চাল, সবজি, পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এর লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন। দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ঘাটতি সম্পর্কে জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি যে সমীক্ষালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তার ওপর খুবই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় মানুষের মৌলিক প্রয়োজন উপেক্ষিত থাকে। মানবিক জীবনবোধ অবহেলিত হয়। সাম্প্রতিক উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে খুবই কষ্টে আছে দেশের দরিদ্র মানুষ। অনেকে কৃচ্ছ্র সাধন করছে, ক্ষুধাকে চেপে যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। এ সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি এবং বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক মহাপরিচালক বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ