মন্দের ভালো বা মরুভূমিতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির মতো গেল বছর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে কিঞ্চিৎ অগ্রগতি হয় বাংলাদেশের। ২০২৫ সালের সূচকে ১৮০টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের ১৪৯তম অবস্থান নানা মন্দের মধ্যে ছিল একটি ভালো খবর। স্কোর ৩৩.৭১। এর আগে, ২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম। স্কোর ২৭.৬৪।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ২০২১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ধারাবাহিকভাবে নিম্নগামী হচ্ছিল। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। পরের বছর ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল।
২০২৩ সালে আরো এক ধাপ পেছায় বাংলাদেশ। পরের বছর পিছিয়েছিল আরো দুই ধাপ। সেখানে ২০২৫ সালের পজিশনটি গণমাধ্যমকর্মীদের ভবিষ্যতের জন্য আরো ভালো কিছুর প্রতি আশাবাদী করে। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালির সমূহ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিয়মিত হামলা-সহিংসতা ক্রমেই বাড়বাড়ন্ত। শকুনের চোখ পড়ার মতো আজ এখানে, কাল সেখানে আক্রান্ত সাংবাদিকরা। এর সর্বশেষ নির্মম শিকার গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন। সত্যের খোঁজে মাঠ চষে বেড়ানো সাংবাদিকদের ওপর ঝুঁকির তীব্রতা কেবলই বাড়ছে। সত্য তুলে আনার অপরাধে গত এক বছরে ২৭৪ জন সাংবাদিককে পিটুনি খেতে হয়েছে।
গত সাত মাসেই ১২৬ জন। সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে এই রাজধানীতে নারী সাংবাদিককে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়েছে। আর হুমকি-ধমকি তো মামুলি ব্যাপার। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দেশের গণমাধ্যম দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার কোনো কোনো ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলকেও নাড়া দিয়েছে। দেশ-বিদেশে সম্পৃক্ত মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের উদ্বেগের জানান দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক নির্ধারণ করা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) তা পর্যবেক্ষণ করছে। এটি তাদের নিয়মিত কাজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। এই অগ্রগতিতে বাহবা নিয়েছে সরকার। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম গর্বের সঙ্গে বলেছেন, গণমাধ্যমে সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকায় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে এক বছরে ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এবার গত বছরের তুলনায় প্রতিটি বিষয়ে ইনডিকেটর ভালো করায় স্বাভাবিকভাবেই আশা জাগছিল আগামী বছরে আরো অগ্রগতির। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেখানে সমপ্রতি অবনতি পিছু নিয়েছে। দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
কিছুদিন কেওয়াজ চলেছে গণমাধ্যমকে জুলাই আন্দোলনের এক নেতার হুমকি-ধমকি নিয়ে। প্রবণতাটি জুলাই চেতনার পরিপন্থী—এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে এই বোধ আসে। সেই পর্ব শেষ না হতেই কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমানে চলছে সাংবাদিক নিপীড়ন। হুমকি-ধমকি, পিটুনির পর এখন যোগ হয়েছে কুপিয়ে মেরে ফেলার পর্ব। জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থান যেসব কারণে সংঘটিত হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। মিডিয়ার ভূমিকায় কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকারের জন্য প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। প্রচলিত আইনের বিধি অনুযায়ী আদালতেও যাওয়া যায়। তা না করে হুমকি-ধমকি, মামলা, আটক, এমনকি মেরে ফেলার মধ্যে দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা, চর্চা ও বিকাশের প্রতিবন্ধকতারই অবতারণা হয়। সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে বিকাশের এই উল্টো কাজ সরকারের জন্যও একটি খারাপ বার্তা। যা কেবল অনভিপ্রেত নয়, তা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচককে আঘাত হানার সমূহ কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে।
পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে ৬০ জনের বেশি সাংবাদিক খুন হয়েছেন। শুধু জুলাই বিপ্লবের সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ছয়জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। যেখানে সাংবাদিকরা সেই ব্যথা-বেদনা সয়ে আগামী দিনে মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতে আশার প্রহর গুনছেন, সেখানে এখন শনির চক্কর। তা কেবল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নয়, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, এমনকি সরকারকে ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যেখানে এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিয়ে গণমাধ্যম সরকারকে সত্য জানিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা করছে, সেখানে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা হামলার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন। রক্তচক্ষুতে কম্পমান গণমাধ্যমের সহযোগী হয়ে দাঁড়ানোর কথা সরকারের, সেখানে গণমাধ্যমই দানবীয়তার শিকার। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকের অবনতি-অগ্রগতি নির্ধারণ করা কর্তৃপক্ষের কাছে এটি কোন মানদণ্ডে বিচার হবে, সেটি অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। উদ্বেগের বিষয় তো বটেই। কে জানে এই সূচকে আগামী দিনে কোথায়, কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থান? তা-ও শান্তিতে নোবেলজয়ীর রেজিমে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের উপস্থিতি, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। গণমাধ্যমেরও অনুষঙ্গ। এ কারণেই বলা হয়, গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। তা পরস্পর সম্পূরক, কখনো কখনো পরিপূরকও। নইলে অন্য প্যারাডক্স জন্ম নেবে। এরই মধ্যে জন্ম নেওয়া শুরুও করেছে। সত্যকে ভয় পাওয়ার পক্ষ গজিয়েছে রাজনীতি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে।
গণমাধ্যমকে তাড়া করা, গণমাধ্যমকর্মীদের হেনস্তা করা বাংলাদেশে অন্যতম সহজ কাজ। এ জন্য খুব ক্ষমতাধর হতে হয় না। বড় কোনো দলের মস্ত নেতাও হতে হয় না। চাইলে যদুমধু গোছের যে কেউ এই কর্মটি সারতে পারে নির্দ্বিধায়। গণমাধ্যমকর্মীরা জগতের অন্যতম নিরীহ প্রাণী। অনেকটা কবি সুকুমার রায়ের ‘করে নাকো ফোঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস’ ছড়ার মতো অবস্থা তাঁদের। তাবৎ গণমাধ্যমকে উৎকণ্ঠায় ফেলে, গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তাহীন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে আগামী প্রান্তিকে কোথায় জায়গা হবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের—এই প্রশ্ন আমলে নিতে দেরি হলে সর্বনাশ হওয়ার অনেক বিষয় রয়েছে। এতে যে লাভবান বা বিকৃত উল্লাস করার মহলও রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন