রফিক আজাদ (১৯৪৩-২০১৬) ষাটের প্রধানতম কবিদের একজন। আঠার মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বন্দি এই কবি আত্মজীবনী ছাড়া খুব একটা গদ্য রচনা করেননি। সত্তর দশকে ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’ কবিতাটি লিখে হইচই ফেলে দেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন। অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা, বাংলা একাডেমি, উপজাতীয় কালচার একাডেমিসহ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক কবিতার বই বেরিয়েছে...
যে পত্রিকাটিকে ঘিরে ষাট দশকের কবিরা আলোকিত হয়েছেন সেই ‘কণ্ঠস্বর’ ত্রৈমাসিকের সম্পাদক কবি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ টাঙ্গাইলকে বলেছেন কবিধাম। ‘কবিধাম’ শব্দটি প্রশংসা করার লক্ষ্যে নেতিবাচকভাবে বলা হয়ে থাকে এভাবে : এ শহরে তিনটি ঢিল ছুড়ে দিলে এর একটি কবির শরীরে এসে পড়বে। আরও খারাপভাবে বলা হয়- কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা নাকি এখানে বেশি। তো, যেভাবেই বিশ্লেষণ হোক ষোল শতক থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত এ জেলার কবিদের তালিকা নজর করলে এ সত্যই বেরিয়ে আসে, প্রকৃত অর্থেই জেলাটি কবির শহর।
এখানে বড় ধরনের কবিসম্মেলন হয়, নিয়মিত পাক্ষিক স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর বসে। বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠ যা ১৯৮০ সালের ৮ জুন স্থানীয় ভাসানী হলে অরণির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল- এ বিষয়টি এখন ইতিহাস। যেহেতু কবিধাম টাঙ্গাইল- এ কারণে কবি পরিচিতিই হোক।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে টাঙ্গাইলে কবিতা-চর্চার ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে টাঙ্গাইলের প্রথম কবি কে-এই প্রশ্নের মীমাংসা এখনো হয়নি। ষোল শতকের প্রথমার্ধের কোনো একসময় কবি শ্রীরায় বিনোদের জন্ম। তাঁর কাছাকাছি কালে জন্মগ্রহণ করেছেন কবি মুকুন্দ ভারতী। শ্রীরায় বিনোদের পদ্মপুরাণের ৪ খণ্ড এবং মুকুন্দ ভারতীর ‘জগন্নাথ বিজয়’ গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। এঁদের কাছাকাছি কালে জন্মেছেন দ্বিজ সৃষ্টি ধর, মুক্তারাম নাগ এবং পূর্ণচন্দ্র মিত্র। ১৭ শতকে জন্মগ্রহণ করেন অন্ধ কবি ভবানী প্রসাদ, তাঁর ভাই গঙ্গাধর দাস এবং কাঁঠালিয়ার রূপনারায়ণ ঘোষ। এসব কবির সঠিক জন্মবৃত্তান্ত এখনো অনাবিষ্কৃত। গ্রন্থাকারে পাণ্ডুলিপি প্রকাশ না হওয়া, পারিবারিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণে অনীহা, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন অনেক নিদর্শনের মতো টাঙ্গাইলের কবিদের পাণ্ডুলিপিও অনেক ক্ষেত্রে বিনষ্ট হয়েছে। যে ক’টি পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, ব্যক্তিগত জীবন তথ্যের অভাবে সেসব পাণ্ডুলিপির লেখকদের কালসীমা নির্ণয়ও কঠিন হয়ে পড়ে। উপর্যুক্ত কবিদের কাব্যভাষার বিচার-বিশ্লেষণ করে আপাত সিদ্ধান্তে আসা যায় শ্রীরায় বিনোদ এবং মুকুন্দ ভারতীই টাঙ্গাইলের প্রাচীন কবি।
১৮১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন চণ্ডীপ্রসাদ নেউগী। তিনি ‘হরিনামা মৃতরস’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেছেন হরিদত্ত, তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলোর মধ্যে ‘ধর্মের পাঁচালী’ এবং ‘কালিকা পুরাণ’ উল্লেখযোগ্য। দুই খণ্ডের ‘উদাসী’ কাব্যের রচয়িতা আবদুল হামিদ খান ইউসুফজাই (১৮৪৫-১৯১০) জন্মগ্রহণ করেন কালিহাতী উপজেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম চারাণে। হেমচন্দ্র ঘোষ (জন্ম : ১৯৬২) পেশায় ছিলেন আইনজীবী। ভারসাম্য, শরশয্যা, সারস্বতোৎসব, প্রীতি উপহার নামে বেরিয়েছে চারটি কাব্য। আনুমানিক উনিশ শতকে জন্ম নেওয়া রসিক চন্দ্রবসু বিদ্যাবিনোদ প্রায় কুড়িটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রমথনাথ রায় চৌধুরী (১৮৭২-১৯৪৯) ছিলেন সন্তোষের জমিদার। ভারতের বিখ্যাত সন্তোষ ট্রফির প্রবর্তক এ পরিবারের সন্তান প্রমথনাথ রায়চৌধুরী নাট্যকার হিসেবেও খ্যাত। কাব্য ও নাটক মিলে তার কুড়িটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রামলোচন দাস (জন্ম : ১৮৭২) বাংলা, সংস্কৃত এবং ফার্সি ভাষায় ছিলেন পারদর্শী। ব্রহ্মকৈবর্ত পুরাণের পদ্যানুবাদ, পদ্মাপুরাণ, কল্কিপুরাণ, প্রেমলহরী, সংগীত রসোত্তর, সংগীতামৃত সিন্ধু ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আবদুল লতিফ খানের (১৮৯০-১৯৭৭) তিনটি কাব্য রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র সেন (১৮৯২-১৯৬৮) ছিলেন ‘আনন্দবাজার’ এবং ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক। গীতমাধুরী কাব্যসহ তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কৃষ্ণদয়াল বসু (১৮৯৭-১৯৭২) শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলেন। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- অন্তরের অন্তরালে, রুনুুঝুনু, ঐতিহাসিক, সৈকদূত, সাঁঝের জুঁই, বনশ্রী ইত্যাদি। রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী (১৯০২-১৯৫২) সনেট লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সুধীর সাহিত্য রঞ্জন (১৯০৮-১৯৮৬) কবি তারাপদ রায়ের পিতা। ‘সন্ধ্যামালতি’ নামে তাঁর একটি কাব্যের খোঁজ পাওয়া যায়। মফিজ উল হক (১৯১৩-২০০৭) মূলত গদ্য লেখক। তাঁর দুটো কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। মুফাখখারুল ইসলাম (১৯২১-২০০৭) চল্লিশ দশকের কবি। তাঁর অনেক গ্রন্থ বেরিয়েছে। ‘জালালী কবুতর’ তাঁর বিখ্যাত কাব্য। চল্লিশ দশকের বিখ্যাত কবি নরেশ গুহ (১৯২৪-২০০৯) দুই বাংলায় সমাদৃত। দুরন্ত দুপুর, তাতার সমুদ্র ঘেরা, বিদিশার ইনি আর উনি ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।
চল্লিশ দশকের আরেক প্রখ্যাত কবির নাম আশরাফ সিদ্দিকী (১৯২৭)। লোকসাহিত্য নিয়ে তাঁর রয়েছে উল্লেখযোগ্য কাজ। সরকারি কলেজে অধ্যাপনা, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ইত্যাদি দায়িত্বশীল কাজ করে এখন অবসরে। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ বেরিয়েছে। ওই সময়ে আর যারা কাব্য চর্চা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস (১৮৯৭-১৯৬৯), আলতাফ হোসেন খান (১৯০৭-১৯৯৪), সিরাজউদ্দিন চৌধুরী (জন্ম : ১৯১৬), আতাউর রহমান খান (১৯১৮-১৯৫১), এস শহীদ (জন্ম : ১৯২২), নুরুন নাহার (১৯২৩-১৯৯১), এম এ লতিফ (১৯২৩-২০০৩), শামসুল হক চৌধুরী (১৯২৭-২০০৩), খান মোহাম্মদ কেরামত আলী (১৯২৩-১৯৮৫), আবদুল করিম মণ্ডল (জন্ম : ১৯৩১), জাহাঙ্গীর খান ইউসুফজাই (১৯৩১-১৯৯৬)।
সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, লোকমান হোসেন ফকির, আবদুস সাত্তার, তারাপদ রায়, পঞ্চাশ দশকের স্বনামধন্য কবি। সাইয়িদ আতীকুল্লাহ (১৯৩৩-১৯৯৮) মূলত কবি কিন্তু গল্পের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। একটিমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘বুধবার রাতে’ অনন্য রচনাশৈলীর জন্য বিখ্যাত। তাঁর কাব্যগুলোর মধ্যে- আমাকে ছাড়া অনেক কিছু, আঁধির যত শত্রু মিত্র, অদম্য পথিকের গান, এই যে তুমুল বৃষ্টি উল্লেখযোগ্য। লোকমান হোসেন ফকির মূলত গীতিকার। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে তাঁর লেখা, ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা/আমায় একজন কালো মানুষ দাও যার রক্ত কালো’ গানটি বহুল প্রচারিত। এরকম বহু বিখ্যাত গানের তিনি রচয়িতা। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম আমি দিন গুনছি। এ ছাড়া গানের বইও রয়েছে কয়েকটি। আবদুস সাত্তার (১৯২৭-২০০৩) এই দশকের একজন খ্যাতিমান কবি। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি উপজাতীয়দের নিয়ে গবেষণা করে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রায় এক শর ওপর গ্রন্থ বেরিয়েছে তাঁর। অখিল নিয়োগী যিনি স্বপন বুড়ো (১৯২৫-১৯৯৩) নামে লিখতেন, তিনি প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। সুকুমার বাগচির (১৯৩৮) শৈশব কেটেছে নাগরপুর। এখন তিনি আসামের গোহাটির বাসিন্দা। তারাপদ রায় (১৯৩৯-২০০৭) উভয় বাংলার বিখ্যাত কবি। বহুমাত্রিক এই লেখকের অসংখ্য গ্রন্থ বেরিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারাপদ রায়ের সমগ্র লেখার অনেকাংশজুড়ে রয়েছে শেকড়ের কথা, তাঁর জন্মভূমির কথা। নাড়ির টান হৃদয়কে কীভাবে ক্ষতবিক্ষত করে ’৪৭-এর পর যারা এপার ওপার হয়েছেন তাঁরা জানেন। তারাপদ রায়ের জন্ম বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন গ্রামে। তাঁর বাবা সুধীর রায় বাড়ি তৈরি করেছেন শহরের পূর্ব আদালতপাড়ায়। এ বাড়িতে তারাপদ রায় থেকেছেন ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত। এক তলা বাড়ির সম্মুখে বড় একটি মাঠ। মাঠের চারদিকে গাছপালা। মাঝে একটি অশোক বৃক্ষ। সেখানে মঞ্চ বানিয়ে পাড়ার ছেলেরা নাটক করত। জায়গাটি হয়ে গেল অশোক রঙ্গমঞ্চ। দক্ষিণে একটি বড় পুকুর। বাড়ির দু’শ গজ দক্ষিণে শ্যামবাবুর খাল। ওপারেই ভিক্টোরিয়া সড়ক। এ খালটি শহরকে দুভাগ করেছিল। ড্রেনেজের বিষয়টি মাথায় রেখে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক লৌহজং ও বুড়াই নদীর সংযোগ এ খালটি কাটান ঠিকাদার শ্যামবাবুর মাধ্যমে। তখন থেকেই খালটির নাম হয়ে যায়- শ্যামবাবুর খাল। তারাপদ রায় বেঁচে থাকলে কষ্ট পেতেন। তাঁর কিছু লেখায় ওই খাল, লৌহজং ও বুড়াই নদীর কথা আছে। কিন্তু, খালটি এখন আর অবশিষ্ট নেই। বাণিজ্যকে লক্ষ্মী ভেবে প্রকৃতির টুঁটি চেপে এখন সেখানে দোকান আর দোকান। লৌহজং নদী মরে গেছে। বুড়াই এখন শুধু নাম। তারাপদ রায় বিন্দুবাসিনী হাই ইংলিশ স্কুল (বর্তমানে সরকারি) থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৫১ সালে কলেজে পড়তে যান কলকাতায়। তাঁর বাবা, মা, এক ভাই দেশে থাকলেও তিনি আর ফিরে আসেননি জন্মভিটায়। বাড়িটির চিহ্ন থাকা পর্যন্ত মাঝে মাঝে তিনি বেড়াতে আসতেন। তাঁর বাবা সুধীর রায় ছিলেন পেশায় আইনজীবী। তাঁকে বলা হতো উকিলদের উকিল। তিনিও কবিতা লিখতেন। ‘সন্ধ্যামালতি’ নামে তাঁর একটি কবিতা পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। তারাপদ রায়ের অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। বিখ্যাত কাব্যগুলো হচ্ছে- তোমার প্রতিমা, নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক, কোথায় যাচ্ছেন তারাপদ বাবু, দুর্ভিক্ষের কবিতা অনুরাগীদের এখনো ঠোঁটে ফেরে।
দশকওয়ারী বিচারে গত শতাব্দীর ষাট দশকে উল্লেখযোগ্য অনেক কবি জন্মেছেন এ জেলায়। এঁদের মধ্যে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁরা হলেন মীর আবুল খায়ের, রফিক আজাদ, অরুণাভ সরকার, বুলবুল খান মাহবুব, আল মুজাহিদী, যোগব্রত চক্রবর্তী, আবু কায়সার, শাহনুর খান, সাযযাদ কাদির ও মাহবুব সাদিক। অকাল প্রয়াত মীর আবুল খায়ের (১৯৩৫-১৯৬১) ছিলেন টাঙ্গাইল আধুনিক কবি সঙ্ঘের সভাপতি। তাঁর একমাত্র কবিতার বই ‘সমুদ্রে ঝিনুক’ মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত হয়েছে।
রফিক আজাদ (১৯৪৩-২০১৬) ষাটের প্রধানতম কবিদের একজন। আঠার মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বন্দি এই কবি আত্মজীবনী ছাড়া খুব একটা গদ্য রচনা করেননি। সত্তর দশকে ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’ কবিতাটি লিখে হইচই ফেলে দেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন। অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা, বাংলা একাডেমি, উপজাতীয় কালচার একাডেমিসহ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেক কবিতার বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- অসম্ভবের পায়ে, সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে, চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া এবং হাতুড়ির নিচে জীবন।
অরুণাভ সরকার (১৯৪১-২০১২) বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কার। কবিখ্যাতি যত তুঙ্গে সে তুলনায় গ্রন্থ সংখ্যা হাতে গোনা। নির্ভুল ভাষায় লিখতে পছন্দ করেন বলে অন্যের লেখায় শব্দ ও ভাষাজনিত ভুল তিনি ধরে ফেলেন। এ কারণে অনেকেই তাকে অপছন্দ করেন। শুদ্ধ ভাষাচর্চায় হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে অরুণাভ সরকারের নাম অগ্রগণ্য। নগরে বাউল, কেউ কিছুই জানে না, নারীরা ফেরে না এই তিনটি কাব্য এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বেচ্ছানির্বাসিত কবি বুলবুল খান মাহবুব (১৯৪২) ছিলেন ঐতিহাসিক স্যাড জেনারেশনের অন্যতম প্রবক্তা। তাঁর কবিতা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন দেয়ালে স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ‘একুশে আমার রক্তে বাজায় অস্থিরতার সুর/বিপ্লব জানি মহামহিরুহ, একুশে’ত অংকুর’- এই বিখ্যাত পঙ্ক্তি দুটো মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রক্তের কারুকাজ, জখমী সাথীকে নিয়ে আমরা দশজন, পূর্ব দিগন্তে সূর্যোদয়, চোখের বদলে চোখ ও মধ্যরাতের কবিতাগুচ্ছ।
একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা এবং বাগ্মী আল মুজাহিদী (১৯৪৩) ষাট দশকের উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে বিবেচিত। তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- হেমলকের পেয়ালা, ধ্রুপদ ও টেরাকোটা, দূত পারাবাত, কারাগারের কবিতা ও সোনালী ঈগল। তিনি একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন।
অকাল প্রয়াত কবি যোগব্রত চক্রবর্তী (১৯৪৩-১৯৭৮) থিতু ছিলেন কলকাতায়। স্বজন বিদ্রোহ, যাদুঘরে সূর্যাস্ত তাঁর কাব্যগন্থের নাম।
সব্যসাচী লেখক আবু কায়সার (১৯৪৫-২০০৫) বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা জীবন। মূলত কবি কিন্তু সিদ্ধহস্ত ছিলেন নানা ধরনের গদ্য রচনায়। কিশোর উপন্যাস রায়হানের রাজহাঁস বহুল পঠিত একটি গ্রন্থ। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ, আমি খুব লাল একটি গাড়িকে, যাদুঘরে প্রজাপতি, জ্যোৎস্নায় মাতাল জেব্রাগুলো ও লজ্জার দেরাজ।
অকাল প্রয়াত কবি শাহনূর খান (১৯৪৬-১৯৯৮)-এর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দুটো। স্মৃতিতে নেই স্বপ্নেও নেই ও অহংকারের সমান। অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা এবং নানা সংস্থায় চাকরি করেছেন। এ দশকের আরেক সব্যসাচী লেখক সাযযাদ কাদির (১৯৪৭-২০১৭)। বহু গ্রন্থ বেরিয়েছে তাঁর। উল্লেখযোগ্য কবিতার বই- যথেচ্ছ ধ্রুপদ, রৌদ্রে প্রতিধ্বনি ও দরোজার কাছে নদী। মাহবুব সাদিক (১৯৪৭) গদ্য ও পদ্যে সমান সিদ্ধহস্ত। বুদ্ধদেব বসুর কবিতার ওপর পিএইচডি করেছেন। ২০০৯ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। নানা বিষয়ের ওপর বই বেরিয়েছে অনেক। কাব্যসংগ্রহসহ উল্লেখযোগ্য কবিতার বই, সন্ধ্যার স্বভাব, স্বপ্ন চৈতন্যের ডালপালা, সুন্দর তোমার নির্জনে, যায় কল্পান্তের কাল ও আদিগন্ত রোদের তিমির। এই দশকের আরও অনেকেই কবিতা লিখেছেন। তাঁরা হলেন রওশন আরা (জন্ম ১৯৩৪), আসাদুল্লাহ চৌধুরী (১৯৩৪-২০০৪), কৃষ্ণানন্দ সাহা রায় (১৯৩৫-২০১৫), চৌধুরী হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী (জন্ম : ১৯৩৭), মুহম্মদ আয়েশ ইউসুফ (১৯৩৭), নিত্যানন্দ পাল (১৯৩৮-১৯৭১) সুবিনয় দাশ (১৯৪১-১৯৯৩), বাদল মেহেদী (১৯৪২), রণজিত বসাক (১৯৪২-২০০৯), সৈয়দ রফিকুল হায়দার (জন্ম : ১৯৪২), পুলকেশ চক্রবর্তী (জন্ম : ১৯৪২), মুশফিকুর রহমান (১৯৪৩-২০০২), আবদুল হালীম খাঁ (১৯৪৪), মুজাফফর আলী তালুকদার (১৯৪৫-২০১২)।
সত্তর দশকের বেশ সংখ্যক কবি জাতীয়ভাবে পরিচিত হয়ে বর্তমানে সমানতালে লিখে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মাহবুব বারী, মাহবুব হাসান, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, আলমগীর রেজা চৌধুরী, সোহরাব পাশা, যুগলপদ সাহা ও আবু মাসুম।
মাহবুব বারী (১৯৫২) আত্মমগ্ন কবি। হ্যাঙ্গার, ঈশ্বরের ছবির ওপর, অধরা ইত্যাদি তাঁর কবিতার বই। মাহবুব হাসান (১৯৫৪)-এর কবিতায় মিথের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কবিতা সংগ্রহ ছাড়াও তন্দ্রার কোলে হরিণ, তোমার প্রতীক, নিসর্গের নুন, তাজা গ্রেনেড কিংবা দিবা স্বপ্নসহ আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
জাহাঙ্গীর ফিরোজ (১৯৫৫) কবি হিসেবে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, বদ্ধমাতাল রোদে, চাকরিজীবীদের কোনো স্পার্টাকাস নেই, যে ছিল প্রাণের জরুরি, ছেঁড়া টুকরো মেঘ, অণুবিশ্বের মেঘমালা ও লালনের পাখি উড়ে যায়।
আলমগীর রেজা চৌধুরীর (১৯৫৫) কবিতায় প্রেমের সনিষ্ঠ উচ্চারণ লক্ষ করা যায়। মূলত কবি কিন্তু উপন্যাস এবং ছোটগল্প লিখতেও সিদ্ধহস্ত। ‘ভালোবাসার অমল চিঠি’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
সোহরাব পাশা (১৯৫৬) প্রবহমান ছন্দে কবিতা লেখেন। পাথররাত্রি, বিকেলের জলপাই রোদে, শরবিদ্ধ স্বপ্নবেলাসহ বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
যুগলপদ সাহা (১৯৩৩-২০২৩) মধ্য বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করলেও ইতোমধ্যে কবি হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম মধ্যাহ্নে একাকী।
এর ছাড়া পুরোনো পৃথিবী সেই এবং পাতার আড়াল থেকে নামে দুটো কাব্যসহ ৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আবু মাসুম (১৯৫৬)-এর কবিতায় ব্যক্তিহৃদয়ের ছাপ স্পষ্ট। পাখির জন্য শোক, জীবনের ভুল প্রান্তে নামে দুটো কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে।
প্রাণজি বসাক (১৯৫৫) শিশু বয়সে পিতামাতার সঙ্গে ভারত চলে যান। বর্তমানে দিল্লির আইটিতে কর্মরত। সত্তর দশকের এই কবির ১০টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। শৈলেন সাহা (১৯৪৩) দিল্লিপ্রবাসী। পেশায় প্রকৌশলী। সত্তর দশকের এই কবির দুটো সম্পাদনাসহ তিনটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে।
এ সময়ে আরও অনেকেই কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশরাফ চৌধুরী (জন্ম : ১৯৪৮), শংকর দাশ (১৯৪৮), এম এ ছাত্তার উকিল (১৯৪৯-২০২৩), মাহবুব মোরশেদ (১৯৪৯) নাজির হোসেন (১৯৫০), ফজলুল হক খান ফরিদ (১৯৫০), আবু হাসান (জন্ম : ১৯৫১), আশরাফ জামান (১৯৫১), দিলওয়ার হাসান (১৯৫১), গোপাল কর্মকার, সোলায়মান মজনু (১৯৫১), জুলফিকার খান (১৯৫২), আবদুল হামিদ খান (জন্ম : ১৯৫২), জিন্নাহ বিন জয়েনুদ্দীন (জন্ম : ১৯৫২), রেজাউল হাসান (১৯৫২), আকবর কবীর (১৯৫৪), শাহ আবদুর রশীদ (১৯৫৪) শাহানা মাহবুব (১৯৫৪) ও শফিকুল হাসান (১৯৫৬)।
আশির দশকে বেশ কয়েকজন উজ্জ্বল কবির আবির্ভাব ঘটেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমরেশ দেবনাথ (জন্ম : ১৯৫৪), কাজী খোদেজা বেগম (১৯৫৪-২০১৮), শ্যামল সেন (১৯৫৫-১৯৯৬) ফেরদৌস সালাম (১৯৫৬) রতন মাহমুদ (১৯৫৬), জহীর হায়দার (১৯৫৯), রোকেয়া ইসলাম (১৯৫৯), শামসেত তাবরেজী (১৯৬০), শফিক ইমতিয়াজ (১৯৬২), জাহিদ মুস্তাফা (১৯৬২), শরীফ শাহরিয়ার (১৯৬৫)। নব্বই দশকে কবিতা ক্ষেত্রে খরা লক্ষ করা গেলেও রাশেদ রহমান (১৯৬৭) এবং বিপ্লব ফারুক (১৯৭১-২০২১) জাতীয়ভাবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে সোহেল হাসান গালিব, শাহজাহান ইমতিয়াজ, শারদুল সজল, নাসরীন রশীদ, তানিয়া বখ্শ, কুশল ভৌমিক, হিমাংশু পাল, রুদ্র মোস্তফা, স্বপন সৌমিত্র, নাসিরুদ্দীন শাহ, এমরান হাসান, মাহফুজ মুজাহিদ, লুৎফুন নাহার লোপা, জারিফ আলম জাতীয় পত্রপত্রিকায় সমানতালে লিখে চলেছেন। এর বাইরেও অসংখ্য কবি কেউ নিয়মিত কেউবা অনিয়মিতভাবে কবিতা লিখে চলেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন। লিখে যাচ্ছেন নিয়মিত এরা হলেন ছন্নছাড়া, সাধন চক্রবর্তী, লক্ষ্মণ গৌড় (১৯৪৭-২০২৪), কোহিনূর বেগম, আবু হাসান, আবদুস সাত্তার পলাশী, জাকিয়া সুলতানা, খুরশীদা রীনা, বাদল মাহমুদ, সানোয়ার রায়হান, ফাতেমা রহমান বীনু, আজম মাহমুদ, মনি খন্দকার, আবদুল হাই রেজা, সিরাজ সৈকত, বুলবুল হায়দার, মোবাশ্বির খলিল, রাজিয়া সুলতানা, বাদল আশরাফ, শাহ আবদুর রশীদ, আজম মাহমুদ, মুসাফির, মো. ইলিয়াস, আমিনুজ্জামান, আনিসুর রহমান খান, চন্দ্রনাথ বসাক, দেবাশীষ দেব, হুমায়ুন তালুকদার (১৯৬০-২০২৪), মোফাজ্জল হোসেন, কালাম খান আজাদ, সাবিলা আকতার ছবি, আখতার হানিফ, সোলায়মান আল মনসুর, আবদুল হাই রেজা, ফরিদ আহমেদ, আল রুহী, সাদি সালমান, নুরুল ইসলাম বাদল, সুব্রত দত্ত, অনীক রহমান বুলবুল, আখতার হোসেন খান, লোকমান হাকিম, রতনচন্দ্র সাহা, ফজলুল হায়দার চৌধুরী, মুকাম্মেল ছোটন, স্বাধীন আজম, শফি কামাল, মনোয়ারুল ইসলাম মনো, জাহাঙ্গীর খান, আহমেদুল হক সিদ্দিকী, রাকীব হোসেন মঈন, ফারুক হোসেন, রতন বসাক (১৯৬৩-২০১৭), সাব্বির হোসাইন, ঝান্ডা চাকলাদার (১৯৬৩-২০২৪), হায়দার আলী সিদ্দিকী, মিয়া মোহাম্মদ হাসান আলী রেজা (জন্ম : ১৯৪৩), আযাদ কামাল, বাবুল আরেফিন, ফিরোজ মান্না, মাসুদুর রহমান, খান নাজমুন নাহার, শওকত মুহম্মদ, সোহেল সৌকর্য, মুক্তাদির ছিন্টু, উজ্জ্বল খান, উদয় হাকিম, আবেদীন জনী, অরণ্য ইমতিয়াজ, রানা আহমেদ, হাসান মাহবুব, গালিব মোল্লাহ জাকির, আহমেদ কিংশুক, ঊর্মি খান, বিদ্যুত খোশনবীশ, ঊর্মি রহমান, নাঈমা পান্না (জন্ম : ১৯৯০), আজাদ বঙ্গবাসী, জাহাঙ্গীর খান, জাহেরুল হক জাহী (১৯৫৩-২০১৮), নুসরাত জাহান মিনা, ফজলে রাব্বী খান, ফারুক আহমেদ খান, আবু আহমেদ শের শাহ, আরিফ আহমেদ, মতিয়ারা মুক্তা, এনায়েত করিম, সুশান্ত সরকার, রুবায়েত রিপন, বিমলেশ রায়, কাশীনাথ মজুমদার পিংকু, হারুনুর রশীদ, আলী রেজা, আরমান আজম, মনসুর মনু, লুৎফা আনোয়ার, ফারহানা ইয়াসমিন, আবির আহমেদ, সাহিদা খান বর্ষা, আলী হাসান, বাসুদেব শীল, মৌমিতা দেব, সবুজ মাহমুদ, জহিরুল ইসলাম মিরাজ, কাজী শামসুল আলম, ডলি সিদ্দিকী, শামীমা আলম স্বাতী, সুমন আহম্মেদ, শাহী শুভ, সুমাইয়া প্রিয়া, শুভব্রতা ইয়াসমিন ও খন্দকার রাইয়ান রহমান।
লেখক পরিচিতি : সত্তর দশকের অন্যতম কবি। অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, সম্পাদনাসহ ৫০-এর অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।