বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাজারো মুসলিম মেয়ের আবাসস্থল হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় হল, মেস বা হোস্টেল। যদিও খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর ঢাকায় আত্মীয়-স্বজন থাকার কারণে একটি নিরাপদ বিকল্প তৈরি হয়, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকেই বাধ্যতামূলকভাবে হলে থাকা শুরু করতে হয়। পর্দা মেনে চলতে চাওয়া মেয়েদের জন্য এই হলজীবন প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো। পরিবার, পরিচিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অপরিচিত মানুষের মধ্যে, কখনো বিধর্মীদের সঙ্গে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে হয়।
এই পরিবর্তন শুধু সামাজিক নয়, বরং পর্দাশীল মুসলিম নারীর জন্য ঈমানের একটি বড় পরীক্ষা। ইসলামে পর্দা নারীর সম্মান, আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। তবে হলজীবনের বাস্তবতা প্রায়ই এই পর্দা রক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
ইসলামে পর্দা কোনো ঐচ্ছিক সংস্কৃতি নয়, বরং কোরআন ও হাদিসে প্রমাণিত ফরজ ইবাদত।
আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তোমার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তারা চিহ্নিত হবে এবং কেউ তাদের উত্ত্যক্ত করবে না।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৯)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তবে যা স্বতঃসিদ্ধ।’ (সুরা : নূর, আয়াত : ৩১)
ইসলামের দৃষ্টিতে পর্দা নারীকে পুরুষের অবাঞ্ছিত দৃষ্টি ও হয়রানি থেকে রক্ষা করে, যা তার সম্মান ও পবিত্রতার জন্য অপরিহার্য।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, হলজীবনে পর্দা রক্ষা করা প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে। একটি বড় সমস্যা হলো, পুরুষ কর্মচারীদের অবাধ প্রবেশ। প্রতিটি তলায়, প্রতিটি দরজায় থাকে পুরুষ কর্মচারীদের অবাধ প্রবেশাধিকার; তাদের মুখোমুখি হতে হয় দিনের বিভিন্ন সময়ে, কখনো নিশ্চিন্তে থাকা যায় না। সকাল, দুপুর বা রাতে পুরুষ ক্লিনার, মিস্ত্রি বা দারোয়ানরা হলে প্রবেশ করেন, যা শরিয়তের বিধানের পরিপন্থী। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যদি তাদের কাছে কিছু চাও, তাহলে পর্দার আড়াল থেকে চাও।
এতে তোমাদের ও তাদের অন্তর পবিত্র থাকবে।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৩)
হাদিসে এসেছে, ‘কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে একা থাকবে না, যদি তার মাহরাম উপস্থিত না থাকে।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৪১)
এই নির্দেশনা থেকে স্পষ্ট যে গায়রে মাহরাম পুরুষের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা নিষিদ্ধ। তবে জরুরি প্রয়োজনে (যেমন—চিকিৎসা বা মেরামত) সীমিত যোগাযোগ জায়েজ, যদি পর্দা ও সতর্কতা বজায় থাকে।
হলজীবনে পর্দার ক্ষেত্রে আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো, আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক, আর সেখানে ছবি না থাকলে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু নেকাবসহ ছবি গ্রহণযোগ্য নয় প্রশাসনের কাছে। ফলে নারীর পর্দা রক্ষার মৌলিক অধিকার এখানেও ক্ষুণ্ন হয়, আর সেই ছবি দেখে হলে প্রবেশের অনুমতি দেয় যে পুরুষ নিরাপত্তাকর্মী, তাকেও এড়ানো যায় না। পর্দাশীল নারীদের জন্য ছবি তোলা এবং তা পুরুষ কর্মীদের হাতে দেওয়া শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবেদনশীল। সমসাময়িক ফতোয়া অনুযায়ী, জরুরি প্রয়োজনে যথাসাধ্য নিয়ম মেনে (যেমন—পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড) ছবি তোলা যায়।
অপ্রকাশ্য আরেকটি বড় সমস্যা হলো কক্ষে অমুসলিম রুমমেটের উপস্থিতি। শরিয়তে অমুসলিম নারীর সঙ্গেও ন্যূনতম পর্দার বিধান আছে, বিশেষত যদি তিনি এমন আচরণে অভ্যস্ত হন, যা ইসলামবিরোধী সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। একই রুমে বসবাস তো বটেই, এমনকি একই বিছানাও শেয়ার করতে হয় অনেক সময়। এতে মুসলিম নারীর ঈমান, চরিত্র, এমনকি মানসিক প্রশান্তিও হুমকির মুখে পড়ে। নিজের মতো করে চলার অধিকার হারিয়ে ফেলে অনেক শিক্ষার্থী। এই পরিস্থিতি মুসলিম নারীদের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষায় বাধা সৃষ্টি করে।
ইসলাম নারীদের শিক্ষায় উৎসাহিত করে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপর জ্ঞানার্জন ফরজ।’
(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪)
আয়েশা (রা.)-এর মতো নারী সাহাবিরা এর উদাহরণ। কিন্তু গায়রে মাহরামদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা ও হলের পরিবেশ প্রায়ই পর্দার বিধানের বিপরীত, যা হয়ে ওঠে ফিতনার কারণ। এই ফিতনা এড়াতে শিক্ষার পরিবেশে পর্দার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
একজন মুসলিম মেয়ের পক্ষে যখন তাঁর দ্বিন ঠিক রেখে উচ্চশিক্ষার পথে চলা সম্ভব হয় না, তখন সেই শিক্ষার ব্যবস্থাপনাকে নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে। সমাধান শুধু ব্যক্তিগত ঈমানদারিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং গোটা সমাজকেই এ বিষয়ে দায় নিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদা ক্যাম্পাস ও হল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। প্রশাসন ও নিরাপত্তায় হিজাবি নারীদের নিয়োগ করা হলে পর্দাশীল পরিবেশ নিশ্চিত হবে। আইডি যাচাইয়ের জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বা নারী কর্মী দ্বারা পরিচালিত প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া রুমমেট নির্বাচনে ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে স্বাধীনতা দেওয়া উচিত, যাতে মুসলিম নারীরা তাঁদের ঈমান ও জীবনাচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সঙ্গী পান। এমন ব্যবস্থাপনায় আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী ক্যাম্পাস উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশ ও সমাজের দায়িত্ব এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে নারীরা উচ্চশিক্ষা নেবে, কিন্তু ঈমান ও আত্মমর্যাদা রক্ষা করে। পর্দা শুধু পোশাক নয়, এটি নারীর পবিত্রতা ও সম্মানের প্রতীক। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারীরা শিক্ষার আলো ছড়াবে, তবে দ্বিনের সঙ্গে আপস করে নয়, বরং আত্মমর্যাদা নিয়ে।
লেখক : শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন