দেশে অপহরণসংক্রান্ত অপরাধের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। গত এক বছরে এই হার দ্বিগুণের বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে অপহরণের শিকার হয়েছে ৭১৫ জন। গত বছর এই একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৩৪০।
অপহরণের দিক থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই এক মাসে অপহরণের শিকার হয়েছে ১০৯ জন। আর গত আট মাসে গড়ে প্রতিদিন তিনজনের বেশি মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে। এই চিত্র আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতির ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের প্রকাশিত মাসিক অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষণে সংখ্যাগত কিছু পার্থক্য থাকলেও অপরাধ বৃদ্ধির মোটামুটি একই চিত্র ফুটে উঠেছে।
অপহরণ এক বছরে দ্বিগুণপুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এইচ এম শাহাদাত হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতি মাসে অপরাধের তথ্য প্রকাশ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সমসাময়িক অপরাধের ‘ট্রেন্ড’ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কখনো কোনো অপরাধ বৃদ্ধি পায়, আবার কখনো কমে। যে অপরাধগুলো বৃদ্ধি পায়, সে বিষয়ে আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করি।”
২০২৪ সালে মোট অপহরণের শিকার হয়েছিল ৬৪২ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৩ জন, মার্চে ৫১ জন, এপ্রিলে ৫৫ জন, মেতে ৫০ জন, জুনে ৩১ জন, জুলাইয়ে ৩২ জন, আগস্টে ২৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৬৫ জন, অক্টোবরে ৯৬ জন, নভেম্বরে ৬৭ জন এবং ডিসেম্বরে অপহরণের শিকার হয় ৭৪ জন। এর মধ্যে আগস্ট পর্যন্ত প্রথম আট মাসে অপহরণের শিকার হয় ৩৪০ জন।
ওই সময় মাসে গড়ে অপহরণ হয়েছে ৪২.৫ জন। চলতি বছরের একই সময়ে এই গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.৩৮ জনে; যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।
এর মধ্যে চলতি বছর জুলাই মাসে অপহরণের শিকার হয়েছে ১০৯ জন, যা গত ছয় বছরের মধ্যে একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এ ছাড়া চলতি বছর জানুয়ারিতে ১০৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৭৮ জন, মার্চে ৮৩ জন, এপ্রিলে ৮৮ জন, মেতে ৮২ জন, জুনে ৮০ জন এবং আগস্ট মাসে অপহরণের শিকার হয় ৯০ জন।
সম্প্রতি প্রকাশিত সিজিএসের ‘বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টস ২০২০-২৫; এ ডেটা-ড্রাইভেন লুক অ্যাট রাইজিং ক্রাইম ট্রেন্ডস’ প্রতিবেদনে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালে মাসে গড় অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৮৬.১৭টি, যা গত বছর ছিল ৫৩.৫। আগের বছরের তুলনায় অপহরণ বেড়েছে ৬১.০৭ শতাংশ। গত ছয় বছরে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড।’
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলার যে সংখ্যা আমরা দেখি, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে বেশি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে অনেক ক্ষেত্রে মামলা করা যায় না। এখন দেশে আইন নেই, আইনের শাসনও নেই। ফলে অপরাধও কমেনি, বরং বেড়েছে।’
অপরাধবিষয়ক পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে অপহরণের হার অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। গত বছর শেষ চার মাসে দিনে গড়ে অপহরণের শিকার হয়েছে ২.৫২ জন। এর ফলে ওই বছর দৈনিক গড় অপহরণের সংখ্যা দাঁড়ায় ১.৭৬ জনে। চলতি বছর প্রথম আট মাসে এই ধারাবাহিকতা আরো বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে দৈনিক গড়ে অপহরণের শিকার হয়েছে ২.৯৮ জন। এর আগে ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দিনে গড়ে অপহরণের সংখ্যা ছিল ১.৩৩ পর্যন্ত।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যখন কোনো অপরাধ বেড়ে যায়, তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কোনো একটি কারণ উপস্থাপন করে তার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে নিয়ন্ত্রকদের এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো অপেশাদারির লক্ষণ। এই চেষ্টার কারণে অপরাধীরা নানাভাবে সুযোগ পায়। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশ ব্যবহৃত হওয়ায় তারা ভিন্ন দল ও মতকে দমন করে। ফলে সমাজে অপরাধের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘গড়ে দৈনিক তিনজন অপহরণের অর্থ হলো দেশে আইনের শাসনের বড় ঘাটতি রয়েছে।’
কর্মহীন হওয়ায় অপরাধ বাড়ছে
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ও পারিবারিক শত্রুতা, ধর্ষণসহ বিভিন্ন কারণে সমাজে অপহরণের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়। তবে দেশে অপহরণের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে আর্থিক কারণে। অপহরণ করে অর্থ আদায়ের মতো ঘটনায় চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততা ছাড়াও পরিবার, নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ পরিবার একজনের উপার্জনে চলে। যখন হঠাৎ তার উপার্জন বন্ধ হয়ে যায় এবং তার আয়ের ওপর পরিবারের অনেক সদস্য নির্ভরশীল হয়, তখন একটা সময় পর্যন্ত কাজ না পেয়ে প্রথমে সঞ্চয় ভেঙে খায়। এরপর ঋণ করে। এক পর্যায়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে এক বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ২০ হাজার।
সাম্প্রতিক তিনটি অপহরণের ঘটনা
গত ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় মুরগি ব্যবসায়ী নুরুল আবছারকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। তাঁর পকেটে থাকা ৪০ হাজার টাকা নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পরে মুক্তিপণ হিসেবে ১৭ লাখ টাকা দাবি করে। তবে পুলিশের তৎপরতায় দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
কুমিল্লায় অপহরণের ৩৬ দিন পর ভুক্তভোগী রিকশাচালক মেহেদী হাসানের মাথার খুলি নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নের উত্তর ত্রিশ এলাকার ঝোপ থেকে উদ্ধার করে সিআইডি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে মৃতদেহ উদ্ধারের পাশাপাশি তাঁকে অপহরণকারী তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান জানান, অটোরিকশা ছিনতাইয়ের জন্য মেহেদীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অপহরণকারীরা স্বীকার করেছে।
এদিকে পাওনা টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে গত ১৫ সেপ্টেম্বর অপহরণের শিকার হন শিবগঞ্জের দাইপুকুরিয়া-বাগবাড়ী গ্রামের শাওবান হোসেনের ছেলে মো. সানি আহম্মেদ। পরে ওই দিন রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের গোলাপবাজার থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ। অপহরণের পর তাঁর পরিবারের কাছে আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ওই অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচজনকে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ