এক সপ্তাহ পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে। বিগত এক বছর দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে নানা পরিবর্তন হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি হাসান শিপলু
প্রশ্ন : অন্তর্বর্তী সরকারকে উত্খাত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য জাতীয় ঐক্য দরকার। কিন্তু দলগুলোর মধ্যে তো বিভক্তি দেখা যাচ্ছে।
উত্তর : গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভক্তি তৈরি করার চেষ্টা চলছে।
এটা সত্য যে, যে, জাতীয় ঐক্য কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার পরও ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য আমাদের ধরে রাখতে হবে। আমাদের প্ল্যাটফর্ম হবে একটা, এর নাম হবে গণঐক্য। এই গণঐক্য হবে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য।
এর কোনো বিকল্প জাতির সামনে নেই।
প্রশ্ন : ক্ষমতায় গেলে ঐকমত্যের সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে, তাতে কি এই ধরনের সরকার গঠন সম্ভব?
উত্তর : যাদের সঙ্গে আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করেছিলাম, তাদের সমন্বয়ে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। রাজনীতির ময়দানে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কৌশল নিয়ে থাকে।
এটাকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভক্তি বলা যাবে না। এটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। আমরা মাঠে নানা বক্তব্য দেব, কিন্তু গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থে একমত থাকব। উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে, সেখানেও ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য দেখা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ডেকে কথা বলেছেন।
সবাই সরকারকে সহযোগিতা করেছে। এখানে কোনো ধরনের বিভক্তি আছে বলে আমি মনে করি না। যা আছে তা হলো নির্বাচন সামনে রেখে একটা রাজনৈতিক কৌশল।
প্রশ্ন : ১৯৫২ সাল থেকে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত অনেক ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পরবর্তী সরকারের ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার নজির শুধু এবারই আছে। এটাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
উত্তর : সরকার পরিচালনায় বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার পাশাপাশি একটি রাষ্ট্র কিভাবে চলে, সে বিষয়ে বিশদ জ্ঞান থাকা জরুরি। যাঁরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হননি, তাঁদের দিয়ে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করি না। কারণ রাষ্ট্র শিশুদের খেলার মাঠ নয়।
প্রশ্ন : আপনি নিজেই গুমের স্বীকার হয়েছেন। গুমের বিচারের বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
উত্তর : আমাকে যে পরিস্থিতিতে যেভাবে গুম করে অন্য একটা দেশে পাচার করা হয়েছে, তা সবার কাছে পরিষ্কার। আমি আট বছর সে দেশে মামলা লড়েছি। শিলংয়ের নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়ার পর ওখানকার সরকার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেই আপিলের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে আরো চার বছর। তার পরও কেন আমি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে দেরি করেছি, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ব্যস্ততা এবং মামলা করার জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে গিয়ে দেরি হয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করলে গুমের বিচার সম্ভব।
রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা
প্রশ্ন : আপনি বললেন, ইতিহাস থেকে রাজনীতিবিদরা শিক্ষা নেননি। তার মানে কি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান থেকেও রাজনৈতিক দলগুলো কিছু শেখেনি?
উত্তর : ৫ আগস্টের চেতনা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা নিয়ে ব্যবসা করা উচিত হবে না। কিন্তু কেউ কেউ ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। সেটা কাম্য হতে পারে না। সে জন্যই বলছি, আমাদের মনে হয় শিক্ষা নেওয়া এখনো বাকি আছে।
প্রশ্ন : ৫ আগস্টের পর ইসলামপন্থী দলগুলোর উত্থানকে কিভাবে দেখছেন?
উত্তর : দেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে সীমাহীন বিভক্তি আছে। এই দলগুলো আরেকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করার চেষ্টা করছে। তবে সব ইসলামী দল মিলে একটি জোট হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ তাদের মধ্যে আদর্শিক পার্থক্য এত বেশি যে, সবাই একই মঞ্চে বক্তব্য দিলেও কিছুদিন পর আরেকটি মঞ্চ তৈরি হবে। তবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো একটা জোট করে নির্বাচন করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা অস্বাভাবিক নয়। এতে উদ্বেগের কিছু দেখি না। কিন্তু এই ধরনের দল খুব সফলভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার ঘটনা বিশ্বে খুবই বিরল।
প্রশ্ন : সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চায় বেশ কয়েকটি দল। আপনাদের সর্বশেষ দলীয় অবস্থান কী?
উত্তর : সংসদের নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক হারে (পিআর) নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এটা আলোচ্যসূচিতে রাখেনি ঐকমত্য কমিশন। পিআর পদ্ধতির বিষয়টি উচ্চকক্ষের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার পর্যায়ে পিআর নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে কি না? সেই প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশনে দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত। বাংলাদেশে তো কোনো রাজ্য নেই। আমরা একক রাষ্ট্র। উচ্চকক্ষের বিধান ফেডারেল সিস্টেমের বাইরে অন্য কোনো দেশে তেমন নেই। বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে উচ্চকক্ষের বিষয়ে যে ধারণা দিয়ে বলা হয়েছে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ বিশিষ্টজনের অবদান সংসদে থাকলে তা জাতি গঠনে ভালো হবে। সেখানে উচ্চকক্ষে আমরা আইন প্রণয়নের ক্ষমতার প্রস্তাব করিনি। সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা থাকবে, তা-ও বলিনি। এখন যে প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশন দিয়েছে, তাতে সবকিছুই আছে। জাতীয় সংসদের সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা পেয়েছেন। কিন্তু একটি অনির্বাচিত কক্ষের (উচ্চকক্ষ) একই ক্ষমতা থাকা কতটা সংবিধানসম্মত? আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সংবিধান সংশোধনসহ যে বিষয়গুলো উচ্চকক্ষের জন্য কমিশন প্রস্তাব করেছে, সেটি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কিংবা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যদি পাস হয়, তবু পিআর পদ্ধতিতে পাস করাতে পারবে না। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করা যেন খুব কঠিন হয়, সে জন্য উচ্চকক্ষকে এই ক্ষমতা দিতে চায় কমিশন। কিন্তু সেটি তো নিম্নকক্ষেও করা যায়। সে জন্য আরেকটা কক্ষ লাগবে কেন? সার্বিক বিবেচনায় প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় এবং জনগণের চাহিদার দিক থেকে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন আছে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নিরূপণ, কত সদস্যের কক্ষ হবে, কিভাবে সেটা গঠিত হবে—এসব নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে।