শিল্পাঙ্গনের মানুষদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে হামিদুজ্জামান খানের পরিবারের সদস্যরা। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী আইভি জামান ও দুই ছেলেসহ অসংখ্য স্বজন ও গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুর আড়াইটায় তার প্রিয় কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে রাখা হবে এই ভাস্করের মরদেহ। এরপর বাদ আছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দাফনের ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমকে কিছুই জানানো হয়নি।
নিউমোনিয়া ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত সপ্তাহে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। অবস্থার অবনতি হওয়াতে প্রথমে আইসিইউ ও পরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় শিল্পীকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাসপাতালটিতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি।
১৯৪৬ সালে কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুজ্জামান খান। ফর্ম, বিষয়ভিত্তিক ও নিরীক্ষাধর্মী ভাস্কর্যের জন্য তিনি সুপরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় নির্মিত একাত্তর স্মরণে শীর্ষক কাজের জন্য তিনি ভাস্কর হিসেবে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে খ্যাতি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী সিউলে অলিম্পিক ভাস্কর্য পার্কে ভাস্কর্য স্থাপনের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতি অর্জন করেন।
১৯৫০-এর দশকে ভাস্কর্য নভেরা আহমেদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভাস্কর্যে আধুনিক ধারার সূচনা ঘটার পরে হামিদুজ্জামান খান তার স্বকীয় ধারার আধুনিক কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভাস্কর্যের প্রসারে অবদান রাখেন। তার ভাস্কর্যে এক্সপ্রেশনিজম বা প্রকাশবাদ, মিনিমালিজম বা অল্পায়নের মতো নির্মাণশৈলী লক্ষ্য করা যায়। তিনি ভাস্কর্য হিসেবে আধা-বিমূর্ত ও বিমূর্ত– উভয় ধারাতেই কাজ করেছেন। ভাস্কর্য ছাড়াও হামিদুজ্জামান খান তার চিত্রকর্মের জন্যও সুপরিচিত। ১৯৬০-এর দশকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন জলরঙের চিত্রকর্মের জন্য তাকে প্রশংসা করেছিলেন ও উৎসাহ দিয়েছিলেন। এছাড়া ১৯৭৬ সালে প্রখ্যাত ভারতীয় শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন মুম্বাইতে একটি প্রদর্শনীতে তার ভাস্কর্যের প্রশংসা করেন। হামিদুজ্জামান খানের জলরঙ ও অ্যাক্রিলিক চিত্রকর্মে বিমূর্ত প্রকাশবাদের ধারা লক্ষ্য করা যায়। তার চিত্রকর্মের প্রধান বিষয়বস্ত নিসর্গ ও মানবশরীর।
ভাস্কর্যে অবদানের জন্য ২০০৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক, ঢাকার সৌন্দর্য বর্ধনের অবদানের জন্য ২০০৬ সালে ঢাকা সিটি পুরস্কার, ২০০৯ সালে এস এম সুলতান পদক ও ২০১২ সালে জয়নুল সম্মাননা লাভ করেন।
১৯৭০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। পাঁচ দশকেরও অধিক সময়ের কর্মজীবনে তার শিল্পকর্ম বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, বুলগেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শিত বা স্থাপিত হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/একেএ