বিশ্বের হিমবাহগুলো অপ্রত্যাশিত হারে গলে যাচ্ছে, যা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। গত তিন বছরে রেকর্ড পরিমাণ বরফ গলার ঘটনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিমবাহ গলার হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জেনেভায় জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড গ্লেসিয়ার মনিটরিং সার্ভিসের পরিচালক মাইকেল জেম্প জানান, ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৯ হাজার গিগাটন বরফ গলেছে। এই পরিমাণ বরফ দিয়ে জার্মানির সমান আয়তনের ২৫ মিটার পুরু বরফখণ্ড তৈরি করা সম্ভব। আর্কটিক, আল্পস, দক্ষিণ আমেরিকা ও তিব্বতীয় মালভূমির হিমবাহগুলো নাটকীয়ভাবে গলে যাচ্ছে, যা বৈশ্বিক পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিমবাহ গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, সুপেয় পানির সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত ও সামাজিক সংকট তীব্রতর হচ্ছে।
বিশ্বের প্রথম "হিমবাহ দিবস" উপলক্ষে ইউনেসকো এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বিশ্বজুড়ে হিমবাহ রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। মাইকেল জেম্প বলেন, গত ছয় বছরের মধ্যে পাঁচ বছরেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বরফ গলার ঘটনা ঘটেছে। শুধু ২০২৪ সালেই হিমবাহগুলোর ভর ৪৫০ গিগাটন হ্রাস পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, পার্বত্য অঞ্চলের হিমবাহ দ্রুত গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, যা বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিতে ফেলছে। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ১১০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এর সরাসরি প্রভাবের মুখে পড়বে।
ইউনেসকোর সদর দপ্তরের বাইরে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এইদি সেভেস্ত্রে বলেন, আমরা মাঠপর্যায়ে যে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি, তা হৃদয়বিদারক। কিছু এলাকায় বরফ গলার হার আমাদের পূর্বাভাসের চেয়েও অনেক বেশি। তিনি পূর্ব আফ্রিকার রোয়েনজোরি মাউন্টেনস এবং কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন, এই অঞ্চলের হিমবাহ ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে।
ইউনেসকোর প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, হিমবাহ গলার ফলে পূর্ব আফ্রিকায় পানিসম্পদকে কেন্দ্র করে সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই সংকটের প্রভাব আপাতত সীমিত, তবে ভবিষ্যতে এটি বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পার্বত্য হিমবাহ গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮ মিলিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ১ মিলিমিটার করে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড গ্লেসিয়ার মনিটরিং সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাত্র ১ মিলিমিটার বাড়লেই বিশ্বজুড়ে তিন লাখ মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে হিমবাহ গলার এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও তীব্র হবে, যা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল