জলবায়ু ঋণের ভয়াবহ ফাঁদে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র ০.৫ শতাংশের জন্য দায়ী হলেও, বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জলবায়ু ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬ মার্কিন ডলার, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে ঋণ-অনুদান অনুপাত ২.৭:১, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় প্রায় চার গুণ। ঋণ ফাঁদ ঝুঁকির স্কোর ১০০ এর মধ্যে ৬৫.৩৭। জলবায়ু অর্থায়নের ৭০ ভাগের বেশিই আসছে ঋণ হিসেবে। ফলে জলবায়ু অর্থায়নের নামে ক্রমেই ঋণের জালে আবদ্ধ হচ্ছে দেশ, যা ঝুঁকিতে ফেলছে দেশের সার্বভৌমত্বকেও।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স (সিডিআরআই-২০২৫)’-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ।
এ ছাড়া বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. এ কে ইনামুল হক, পিকেএসএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদ, সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের কো-অপারেশন অফিসার শিরিন লিরা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রিন স্পিকার ফারিয়া হোসাইন ইকরা, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ড. সাইমন পারভেজ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্মসচিব ড. কাজী শাহজাহানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে ঋণের বোঝায় বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে। এ ছাড়া বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবি) থেকে গৃহীত ঋণের অনুপাত ০.৯৪, যা বৈশ্বিক গড় ০.১৯-এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। বাংলাদেশের জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন খাতের বিনিয়োগ অনুপাত মাত্র ০.৪২, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর গড় অনুপাতের অর্ধেকেরও কম। এতে অর্থায়নের অভাবে জলবায়ু সহনশীলতা অর্জনের প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের পরিবারগুলো স্ব-অর্থায়নে জলবায়ু ঘটিত বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার জন্য প্রতি বছর মাথাপিছু গড়ে ১০ হাজার ৭০০ টাকা ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে, যা জাতীয় পর্যায়ে বার্ষিক ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান।
বক্তারা বলেন, যে অর্থ আমাদের অনুদান হিসেবে পাওয়ার কথা, দাবি উত্থাপন করতে না পারায় সেই অর্থ আমরা ঋণ হিসেবে পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক আরোপ করল, তখন আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনার কথা বলতে পারতাম। কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর পণ্য ও সেবায় আমরা কার্বন ট্যাক্স আরোপ করতে পারি। পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ে উল্লিখিত অসম কার্বন নিঃসরণ প্রশ্নে বাংলাদেশকে সাড়া দিতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ও এনডিসি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এম জাকির হোসেন খান বলেন, প্যারিস চুক্তির ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থাটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য একটি ‘জলবায়ু ঋণ ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়নের বেশির ভাগ আসছে ঋণ হিসেবে, যা সংকটাপন্ন দেশগুলোকে দ্বিগুণ ক্ষতির মুখে ফেলছে। একদিকে দেশগুলো উপর্যুপরি জলবায়ু ঘটিত বিপর্যয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একই সঙ্গে ঋণের ক্রমবর্ধমান কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। দৃঢ় অঙ্গীকার ও স্পষ্ট শাসনব্যবস্থা না থাকলে কপ-২৯ এ ঘোষিত ১ বিলিয়ন ডলারের ‘ক্লাইমেট ফাইন্যান্স অ্যাকশন ফান্ড’ উচ্চাশাই থেকে যাবে; ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রকৃত লাইফলাইনে পরিণত হবে না।