খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ঢাংমারী গ্রামের শাওন সরদার (১৮)। পেশায় মৌয়াল। তার বাবা, দাদারাও পেশায় মৌয়াল। ১২ বছর বয়স থেকেই শাওন সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ শুরু করেন। গত বছর সুন্দরবনের গভীরে মধু সংগ্রহে গিয়ে বাঘের মুখ থেকে জীবন নিয়ে বেঁচে ফেরেন। এরপর বনের ভিতরে ঢোকার সাহস হারিয়ে ফেলেন। এখন সুন্দরবনের পশুর নদীতে ডিঙ্গি নৌকা চালান তিনি। শাওনের মতো স্থানীয় অনেক তরুণ এখন আর এ পেশায় থাকতে আগ্রহী নন। এরকম কয়েকজনের সঙ্গে সম্প্রতি সুন্দরবনে এই প্রতিনিধির আলাপে জানা যায়, বন বিভাগের কর্মচারীদের চাঁদাবাজি, জলদস্যুদের উৎপাত, বনের গহিনে জীবনের অনিশ্চয়তা, আগের তুলনায় কম মধু আহরণ, আশপাশে বিভিন্ন রিসোর্ট গড়ে ওঠা, পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি এবং ট্যুরিজমভিত্তিক পেশায় কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ায় সুন্দরবনের মৌয়ালরা তাদের পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এতে এ বনে মৌয়ালদের সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে।
মৌয়াল শাওন সরদার বলেন, ‘বনের ভিতর মৌমাছির চাক খুঁজতে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের চোখ সবসময় ওপরে গাছের দিকে থাকত। আর টানা ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে আশপাশে কোনো প্রাণী একেবারে কাছে চলে এলেও টের পেতাম না। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মৌয়ালরা অনেকটা জীবন হাতে নিয়ে বনের মধ্যে যান। আমার বাবার এক বন্ধু একবার বনে লাকড়ি (গাছের ডাল-পালা) সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হন। সে যাত্রায় চাচা বেঁচে গেলেও বাঘের থাবায় তার মুখের চোয়ালের অংশ পুরো বেঁকে যায়। আমি মধু সংগ্রহের পাশাপাশি সুন্দরবনে মাছ ধরতাম, লাকড়ি সংগ্রহ করতাম। কিন্তু রিসোর্টগুলোতে কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ায় এখন বনে গিয়ে মধু সংগ্রহের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের প্রজন্মের ছেলেরা এখন আর মৌয়াল পেশায় যেতে চায় না।’ শীতের পর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মৌসুম। প্রতি মৌসুমে বন বিভাগ থেকে মৌয়ালরা এক সপ্তাহের পাস নিয়ে বনের ভিতরে প্রবেশ করেন। নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে বন বিভাগ মৌয়ালদের এই পাস দেয়। অভিযোগ আছে, এরপরও বনের ভিতরে যাওয়ার পর প্রতিবার তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ অনৈতিকভাবে আদায় করেন বন বিভাগের কিছু কর্মচারী। বনে পাস নিয়ে প্রবেশের আগে নিজের নাম লেখানোর সময় মৌয়ালদের ফের অর্থ দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকতে হয়।
এ ক্ষেত্রে মৌয়ালদের ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই প্রতিবেদককে কয়েকজন মৌয়াল জানান, সুন্দরবনের জল ও ডাঙ্গা সব স্থানেই বিপদ ওত পেতে থাকে। বনের ভিতরে হাঁটতে গিয়ে অনেক সময় গাছের শ্বাসমূল পায়ে ঢুকে যায়। কখনো সাপ কামড়ে দেয়। আর বাঘ-কুমিরের আক্রমণের ভয়তো আছেই। গাছে ওঠার সময় তীব্র ধোঁয়ার কারণে মৌয়ালদের খুব কষ্ট হয়। বিশেষ করে শ্বাস নিতে সমস্যা হয়।