ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কোরআন অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছিল ৩০০ বছর আগে। এই কাজে নেতৃত্ব দেন ইন্দোনেশিয়ার প্রসিদ্ধ আলেম ও সুফিসাধক শায়খ আবদুর রউফ ফানসুরি সিনকিলি (রহ.)। তিনি ছিলেন সুলতানা সাফিয়াতুদ্দিনের আস্থাভাজন এবং অচেহ সালতানাত, যা ‘অচেহ দারুস সালাম’ নামেও পরিচিত তার প্রধান মুফতি। ইন্দোনেশিয়ায় সাত্তারিয়া ও কাদেরিয়া সুফি তরিকার প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ধর্মীয় জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার কারণে তাঁকে ‘তরজুমানুল মুস্তাফিদ’ (কল্যাণকামীদের মুখপাত্র) বলা হতো। তিনি ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে উচ্চতর ইসলামী জ্ঞানার্জনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে গমন করেন এবং মক্কা, মদিনা, জেদ্দা, ইয়েমেন ও দোহার প্রসিদ্ধ আলেমদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। তিনি সুফি আলেম আহমদ আল কুরাশি (রহ.) এবং ইবরাহিম আল কোরানি (রহ.)-এর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা অর্জন করেন।
শায়খ আবদুর রউফ সিনকিলি (রহ.) খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সর্বপ্রথম মালয় ভাষায় কোরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করেন।
তাঁর এই অনুবাদ ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কোরআন অনুবাদের দরজা উন্মুক্ত করেছিল। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পরে আরো অনেক আলেম ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করেন। তবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত শায়খ আবদুর রউফ সিনকিলি (রহ.)-এর অনুবাদটিই ছিল মালয় (ও ইন্দোনেশিয়ান) ভাষায় পবিত্র কোরআনের একমাত্র অনুবাদ।
হিজরি চতুর্দশ শতকের শুরুর ভাগে (খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের শেষে) ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কোরআন অনুবাদের নতুনধারা শুরু হয়।
তখন একাধিক আলেম কোরআনের অনুবাদ করেন। যেমন ১৩০৫ হিজরিতে কোরআনের অনুবাদ করেন শায়খ মুহাম্মদ নুরি বানতানি (রহ.)। তিনি এর নাম দেন ‘মুরাহুল লাবিদ লি-কাশফি মা’না কোরআনিল মাজিদ’। এই অনুবাদটি তুলনামূলক অধিক গ্রহণযোগ্য।
১৩১০ হিজরিতে শায়খ মুহাম্মদ সালিহ দারাত (রহ.)-এর তাফসির গ্রন্থ ‘ফয়জুর রহমান’ প্রকাশিত হয়।
এটা ছিল জাভানিজ ভাষায় প্রথম কোরআনের তরজমা ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ। একই সময়ে কোরআনের অনুবাদ করেন উস্তাদ মুনাওয়ার খলিল। তাঁর অনুবাদের নাম ‘আল কোরআন হেদায়াতুর রহমান’। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে শায়খ আহমদ হাসান বান্দুজি (রহ.) ‘আল ফোরকান’ নামে একটি কোরআনের অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তিনি অনুবাদের পাশাপাশি আয়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধানও বর্ণনা করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় শায়খ মাহমুদ ইউনুস (রহ.)-এর অনুবাদ ‘তরজমাতুল কোরআন’।
১৯৫৬ সালে শায়খ হাসবি সিদ্দিকি (রহ.) কোরআনের অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর অনুবাদে তিনি একই আয়াতের একাধিক অনুবাদ পেশ করেছেন এবং এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করেছেন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে কোরআনের অনুবাদ করেন হাজি জয়নুদ্দিন হামিদি ও ফখরুদ্দিন (রহ.)। তাঁদের অনুবাদটি ‘আল কোরআনুল কারিম’ নামে প্রকাশিত হয়। এটি ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় সবচেয়ে সাবলীল কোরআনের অনুবাদ।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় শায়খ হাজি বাসরি মোস্তফা (রহ.)-এর অনুবাদ ‘আল ইবরিজ লি-মারিফাতিল কোরআন’। একই সময়ে প্রকাশিত হয় শায়খ বখতিয়ার সুরিন (রহ.)-এর কোরআনের অনুবাদ ‘তরজমা ওয়া তাফসিরুল কোরআন’। ইন্দোনেশিয়ার আঞ্চলিক ভাষা ‘বোকোসিয়্যা’তে কোরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ লেখেন শায়খ হাজি আবদুল মঈন ইউসুফ, যার নাম রাখেন ‘তাফসিরুল কোরআনিল কারিম’।
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কোরআন অনুবাদের প্রচেষ্টা ৩০০ বছর আগে শুরু হলেও উনিশ ও বিশ শতকে এসে তা বেগবান হয়। এই সময় তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য অনুবাদ ও ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলো রচিত। ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় প্রচলিত কোরআনের অনুবাদের মধ্যে হাসবি সিদ্দিকির অনুবাদই জনপ্রিয় ও অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। কেননা তিনি অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির রচনার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য উৎসগুলোর অনুসন্ধান করেছেন।
তথ্যঋণ : ইসলাম ওয়েব ডটনেট