কিছু কাজ আছে, যা কল্যাণের উৎস আবার কিছু কাজ আছে, যা অকল্যাণের উৎস- এমন কিছু বিষয় এসেছে একটি হাদিসে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘তিনটি জিনিস মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে- ১. গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা, ২. আনন্দ ও ক্রোধের সময় সত্য কথা বলা, ৩. সচ্ছলতা ও দরিদ্রতা উভয় অবস্থায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা।
আর তিনটি জিনিস ধ্বংস ডেকে আনে-
১. লোভের বশবর্তী হওয়া, ২. প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, ৩. আত্মপ্রশংসা করা। (তাবরানি, হাদিস : ৩০৪৫; বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৬৮৬৫)
এই গুণগুলো অর্জন করার জন্য রাসুল (সা.) এভাবে দোয়া করতেন : ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে গোপনে ও প্রকাশ্যে তোমার ভয় অর্জনের তাওফিক চাই; আনন্দে ও ক্রোধে সত্য কথা বলার শক্তি চাই এবং সচ্ছলতা ও দারিদ্র্যে মধ্যপন্থা অবলম্বনের সামর্থ্য প্রার্থনা করি। ’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৩০৫),
আল্লাহভীতি সব কল্যাণের মূল ভিত্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য এক পথ বের করে দেবেন।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ২)।
অর্থাৎ আল্লাহ তাকে প্রত্যেক বিপদ থেকে মুক্তি দেবেন। যেমন- তিনি মা হাজেরা (আ.)-কে পানির অভাবে উদ্বিগ্ন অবস্থায় সান্ত্বনাস্বরূপ জমজম কূপ উপহার দিয়েছিলেন, গুহায় তিন ব্যক্তিকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন।
মহান আল্লাহ নবী আইয়ুব (আ.)-কে সুস্থতা দান করেছিলেন। ‘লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’-অযুত কল্যাণের উৎস। ইসহাক গাজওয়ানি (রহ.) বলেন, পারস্যের এক প্রভাবশালী নেতা আজদামির, ৮০টি হাতি নিয়ে কাইরজ শহরের দিকে আমাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। মুসলিম বাহিনীর ঘোড়া ও সৈন্যদল প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
মুসলমানদের সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম (রহ.) এ পরিস্থিতিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যখন অবস্থা আরো সংকটজনক হয়ে উঠল, মুহাম্মদ বিন কাসিম বারবার উচ্চৈঃস্বরে বলতে লাগলেন, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ আল্লাহ তাআলা তখন হাতিগুলো থামিয়ে দেন এবং তাদের ওপর প্রচণ্ড গরম নিক্ষেপ করেন, ফলে তারা আতঙ্কিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। তখন মুসলিমদের অশ্বারোহীরা পাল্টা আক্রমণ চালায়, আর আল্লাহর ইচ্ছায় বিজয় অর্জিত হয়।
সদা সত্য বলা ও সৎ জীবনাচার জীবনে কল্যাণ নিয়ে আসে। সুখ-দুঃখ, তৃপ্তি-ক্রোধে সদা সত্য বলা। রাগে কিংবা সন্তুষ্টিতে, নিজের সঙ্গে বা প্রতিবেশীর সঙ্গে সর্বদা সত্য বলা। তাই মানুষের উচিত নিজেকে সত্য বলার অভ্যাস করানো এবং ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের সত্যবাদিতার শিক্ষা দেওয়া।
মধ্যপন্থা জীবনে কল্যাণ নিয়ে আসে। সচ্ছলতা ও দারিদ্র্য উভয় অবস্থায়ই মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উচিত। অনেক মানুষ আছে, যখন তাদের হাতে অর্থ আসে, তখন তারা অপচয় ও অযৌক্তিক ব্যয়ে লিপ্ত হয়; আবার যখন অভাব দেখা দেয়, তখন তারা চরম কৃপণ হয়ে যায়। তাদের জীবনে না থাকে বাজেট, না থাকে আর্থিক ভারসাম্য।
আল্লাহ তাআলা বলেন ‘তোমার হাতকে তোমার গলায় শৃঙ্খলিত করে রেখো না এবং তা অযথা সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রসারিতও কোরো না।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৯)।
প্রিয় বান্দাদের প্রশংসা করে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যখন তারা ব্যয় করে, তখন না অপচয় করে, না কৃপণতা করে; বরং উভয়ের মধ্যে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে।’ (সুরা: ফুরকান, আয়াত : ৬৭)।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, ‘লোভ কৃপণতার চেয়েও খারাপ।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ২২৭)।
কারণ কৃপণ ব্যক্তি শুধু নিজের সম্পদ আঁকড়ে ধরে রাখে এবং তা দান করতে চায় না। কিন্তু লোভী ব্যক্তি শুধু নিজের সম্পদ নিয়েই কৃপণ থাকে না; বরং অন্যের যা কিছু আছে, তাতেও লোভ করে, সুযোগ পেলে তা ছিনিয়ে নেয় এবং মানুষের হক নষ্ট করে। তাই লোভ মানুষের মধ্যে অবিচার ও অন্যায়ের বীজ বপন করে; সে শুধু ভালো কাজ থেকে বিরতই থাকে না, বরং অনেক সময় ভালো কাজকে ঘৃণাও করে।
রাসুল (সা.) আমাদের সতর্ক করে বলেছেন : ‘এমন যুগ আসবে, যখন সময় দ্রুত কেটে যাবে, আমল কমে যাবে, লোভ বৃদ্ধি পাবে এবং ফিতনা-ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়বে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৬১)। তিনি আরো বলেন ‘লোভ ও ঈমান কখনো এক বান্দার হৃদয়ে একসঙ্গে থাকতে পারে না।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩১১০)।
সবচেয়ে নিকৃষ্ট গুণ হলো লোভ, কৃপণতা, ও কাপুরুষতা। মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮০১০)
একবার হাসান বসরি (রহ.) মৃতের উত্তরাধিকারীদের উপদেশ দিয়ে বলেন, হে উত্তরাধিকারী! সাবধান, তোমরা তোমার বন্ধুর মতো প্রতারিত হয়ো না। এই সম্পদ এখন বৈধভাবে তোমার কাছে এসেছে অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে। সুতরাং তোমরা এর হক আদায় করো, আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং এতে প্রতারিত হয়ো না। কিয়ামতের দিন এই অর্থ যেন তোমাদের ওপর কোনো বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। আর এই সম্পদ তোমাদের কাছে এসেছে ক্ষমা ও পবিত্র দানের মতো অর্থাৎ এই অর্থ সেই সমুদ্রের গভীরতা ও মরুভূমির বিশালতা পার করে এসেছে, যার জন্য তুমি কোনো শপথ করোনি, তোমার কপালও ঘামায়নি। কিয়ামতের দিন আসবে, ওই দিন সর্বকালের সবচেয়ে অনুশোচনাময় দিন। সেদিন তোমার সম্পদ তোমাকে ছেড়ে অন্য কারো হাতে চলে যাবে। এটি এমন এক অনুশোচনা, যা কখনো মিটবে না।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ