অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে করপোরেট জগতের অবদান অনস্বীকার্য। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অসিলায় বহু মানুষ হালালভাবে সুশৃঙ্খল পরিবেশে রিজিক অন্বেষণ করার সুযোগ পাচ্ছে। উন্নত জীবন উপভোগ করছে।
এই জগৎ এমন একটা জগৎ, যেখানে মানুষ পরস্পর সহযোগিতা, উদারতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, জবাবদিহিকে প্রাধান্য দেয়। একজন ঈমানদারের মধ্যে ঈমানের পাশাপাশি পেশাগত জীবনে যেসব চারিত্রিক গুণ থাকা আবশ্যক, একজন সত্যিকারের করপোরেট চাকরিজীবীর মধ্যেও তা থাকা জরুরি। কিন্তু কখনো কখনো কিছু অসাধু ও চতুর লোকের কারণে এই অঙ্গনটি কলঙ্কিত হয়। মালিকপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্য কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির চর্চা ও পা চেটে বড় হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। গুছিয়ে মিথ্যা বলা, সাবলীল কথার ফাঁদে মালিক/গ্রাহককে বোকা বানানো, প্রমাণ না রেখে কম্পানির সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া, কৌশলে অন্যদের দোষারোপ করে নিজের আখের গোছানোকেই মানুষ সফলতার চাবি ভাবতে থাকে।
অথচ এই প্রতিটি কাজই মানুষের ঈমান-আমলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিচে ইসলামের আলোকে করপোরেট জগেক কলুসিতকারী কিছু অভিনব অপরাধ তুলে ধরা হলো—
ভুয়া ভেন্ডর তৈরি ও বিলিং : কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার কারণে করপোরেট জগৎ থেকে কর্মচারীদের জন্য অর্থ হাতিয়ে নেওয়া কঠিন কাজ। তাই তারা এখান থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে বিভিন্ন অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করে। তার মধ্যে একটি হলো, কর্মকর্তা বা হিসাব বিভাগের কেউ ভুয়া কম্পানি বা ভুয়া ভেন্ডর তৈরি করে নিয়মিত পেমেন্টের বিল জমা দেয়, যা আসলে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি অ্যাকাউন্টে যায়।
এর উদ্দেশ্য হয়, ভুয়া দলিল প্রমাণ তৈরি করে কম্পানির চোখে ধুলা দেওয়া। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি প্রতারণার শামিল। ইসলামে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া, ভুয়া প্রমাণপত্র তৈরি করে বিচারকের দারস্থ হওয়া নিষেধ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনে শুনে পাপের পথে গ্রাস করবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
ওভার ইনভয়েসিং : অনেক ক্ষেত্রে অফিসগুলোর প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় ক্রয়কৃত পণ্যের আসল মূল্য গোপন করে অতিরিক্ত মূল্যে বিল বানিয়ে দেওয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিলে যে পরিমাণ পণ্য উল্লেখ থাকে, বাস্তবে মাপলে তার চেয়ে অনেক কম পাওয়া যায়। মূলত এটি করা হয়, এই কেনাকাটা থেকে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। যে অর্থগুলো কম্পানির অসাধু দায়িত্বশীল কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে গোপনে ভাগ করে নেয়। এখানে পণ্য সরবরাহ করা ব্যবসায়ী ও কম্পানির অসাধু কর্মচারীরা যৌথভাবে সম্পৃক্ত থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটিও হারাম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা পরিমাপে কম দেয়। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন তাদের মেপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। (সুরা মুতাফফিফিন, হাদিস : ১-৩)
রাসুল (সা.) বলেছেন, যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়। (তিরমিজি, হাদিস : ১৩১৫)
ভুয়া খরচ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ : অনেক সময় কম্পানির কর্মকর্তারা ভুয়া ভ্রমণ, হোটেল বিল, রেস্টুরেন্ট, ব্যাবসায়িক মিটিংয়ের খরচ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে থাকেন। ইসলামের দৃষ্টিতে এটিকে ‘খিয়ানত’ বলে। এসব কাজের কারণে তাঁদের ওপর রাখা কম্পানির আমানতগুলো বিনষ্ট হয়। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য আমানতের খিয়ানত করা নিষিদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা জেনে বুঝে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না, আর যে বিষয়ে তোমরা আমানত প্রাপ্ত হয়েছ তাতেও বিশ্বাস ভঙ্গ করো না।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ২৭)
করপোরেট ক্রেডিট কার্ডের অপব্যবহার : করপোরেট কার্ড দিয়ে ব্যক্তিগত খরচ চালিয়ে ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অফিশিয়াল খাত দেখিয়ে দেওয়া কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাজেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করে প্রতিষ্ঠানকে ঋণগ্রস্ত করে দেওয়াও খিয়ানতের শামিল, যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
নির্মাণ বা সাজসজ্জার অজুহাতে অর্থ লোপাট : করপোরেট অফিসগুলো যেহেতু পরিপাটি রাখা বাধ্যতামূলক, তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের জন্য অফিস নির্মাণ বা সাজসজ্জার অজুহাতে কাগজপত্রে বাড়িয়ে বাজেট দেখানো হয় এবং ভুয়া কনট্রাক্টরের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। মালিক ঠকানোর এই পাপ দুনিয়াতে প্রকাশ না পেলেও কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ প্রকাশ করে দেবেন।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই প্রতারণাকারীর জন্য আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন একটি পতাকা উড্ডীন করবেন। তখন বলা হবে, এটি অমুকের ধোঁকাবাজির পতাকা। (মুসলিম, হাদিস : ৪৪২৩)
কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে অর্থ আদায় : অনেক সময় দেখা যায়, বড় বড় কম্পানির বিপথগ্রস্ত কর্মকর্তারা কৃত্রিম সমস্যা তৈরি করে তা সমাধানের জন্য মালিকপক্ষের থেকে বড় বাজেট পাস করিয়ে নেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সেবানির্ভর কম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে গ্রাহক থেকে নির্দিষ্ট সেবা ফির বাইরে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন, যাতে কম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ন হয়, ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কম্পানির মালিকপক্ষ তা টেরই পায় না। এভাবে মালিক বা গ্রাহককে ঠকানোও চরম খিয়ানত। পবিত্র কোরআনে এ ধরনের সংকট সৃষ্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর লোকদের তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিও না এবং জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আশ-শুআরা, আয়াত : ১৮৩)
অ্যাকাউন্টস ও অডিটের লুপহোল ব্যবহার : কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ঢাকতে অডিট রিপোর্ট ম্যানিপুলেট করে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে নিরীক্ষকদের বিভ্রান্ত করা হয়। এতে সুবিধাভোগী কিছু দুর্নীতিবাজ লাভবান হলেও মালিকপক্ষ প্রতারিত হয়। অথচ এই প্রকারের প্রতারণার মাধ্যমে মালিকপক্ষ কিংবা দুনিয়াকে ধোঁকা দেওয়া গেলেও মহান আল্লাহকে তো ধোঁকা দেওয়া যায় না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, যে ব্যক্তি তা গোপন করে, তার অন্তর পাপী। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৩)
বিডি প্রতিদিন/নাজিম