মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত এবং সেই সঙ্গে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। অথচ সেই মানুষ ষড়রিপুর তাড়নায় নানাবিধ পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ মনুষ্যত্বের গুণাবলি হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া অত্যাবশ্যক। মহান আল্লাহর দরবারে কায়ামনোবাক্যে তওবা ব্যতীত পাপ থেকে ক্ষমা পাওয়ার বিকল্প কোনো পন্থা নেই।
তওবার সংজ্ঞা : তওবা আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ অনুতপ্ত হওয়া, অনুশোচনা করা, ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ তওবা সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘পুনরায় পাপ না করার সংকল্পসূচক উক্তি।’ মূলত ভুলপথে ধাবিত বা পাপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে ভবিষ্যতে ভুল বা পাপের পুনরাবৃত্তি হবে না এই নিশ্চয়তা প্রদান করে খালেছ দিলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়াকে তওবা বলা হয়। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় মানুষের পাপ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সেই পাপ থেকে বাঁচার পথ ইসলাম ধর্মে সুস্পষ্ট বর্ণিত আছে। পাপমুক্ত জীবন গঠন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নিয়মিত তওবা করা অপরিহার্য। যে তওবার পর পাপকর্মের পুনরাবৃত্তি হয় না, তাকে ‘তওবাতুন নাসুহা’ অর্থাৎ খাঁটি তওবা বলে।
পবিত্র কোরআনের আলোকে তওবার গুরুত্ব : আল কোরআনে ‘সুরা তওবা’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সুরার অনেক আয়াতে তওবার গুরুত্ব উপস্থাপিত হয়েছে এবং মুমিনদের তওবা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তওবা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের উল্লেখযোগ্য কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হলো-
আল্লাহ তওবা কবুলকারী : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ফরমান, ‘কিন্তু যারা তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে আর সুস্পষ্টভাবে যা গোপন করেছিল তা ব্যক্ত করে, এদেরই তওবা আমি কবুল করি, আর আমি তো পরম তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা ২ : আয়াত ১৬০)
তওবাকারীর জন্য পুরস্কার : ‘অবশ্য যারা তওবা করে, নিজেদের সংশোধন করে, আল্লাহর পথকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে এবং আল্লাহর উদ্দেশে স্বীয় দীনে একনিষ্ঠ থাকে, তারা থাকবে মুমিনদের সঙ্গে। আর অচিরেই আল্লাহ মুমিনদের মহা পুরস্কার প্রদান করবেন।’ (সুরা নিসা ৪ : আয়াত ১৪৬)
তওবাকারীদের আল্লাহ ভালোবাসেন : ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা ২ : আয়াত ২২২)
তওবাকারীর জন্য জান্নাত : ‘হে মুমিনগণ যারা ইমান এনেছো! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, খাঁটি তওবা। আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের মন্দ কর্মসমূূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের দাখিল করবেন জান্নাতে, প্রবাহিত হয় যার নিম্নদেশে নহরসমূূহ।’ (সুরা তাহরিম ৬৬ : আয়াত ৮) সুতরাং মানুষ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছকৃতভাবে পাপকর্ম করে যদি তার ভিতর পাপের জন্য অনুশোচনা এবং সৎ কর্ম করার প্রেরণা জাগ্রত হয়, অতঃপর সে যদি মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে আল্লাহ তাঁর ‘গাফুর’ নামের বরকতে পাপী ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর ‘আত তাওয়্যাব’ নামের বরকতে পাপী ব্যক্তির তওবা কবুল করে থাকেন।
হাদিসের আলোকে তওবার গুরুত্ব
হজরত রসুল (সা.) তওবার গুরুত্ব সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণনা করেছেন। যে হাদিসগুলো বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে একজন পাপী ব্যক্তি তওবা করে যাবতীয় পাপকর্ম থেকে মুক্ত হয়ে আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। আল্লাহর রসুল (সা.) আরও ফরমান, ‘রুহ কণ্ঠায় না পৌঁছা পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা বান্দার তওবা অবশ্যই কবুল করবেন।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস নম্বর ৩৫৩৭) হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক রাতের তিন ভাগের শেষ ভাগে (এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে) প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন কে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে কিছু চায়, আমি তাকে দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা চায়, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস নম্বর ১১৩৪)
তওবা ভঙ্গকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না : আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আর তওবা তাদের জন্য নয়, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সে বলে : আমি এখন তওবা করছি; আর তাদের জন্যও নয়, যারা মারা যায় কাফের অবস্থায়। এরূপ লোকদের জন্যই আমি প্রস্তুত করে রেখেছি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা নিসা ৪ : আয়াত ১৮) সুতরাং স্পষ্ট যে, নির্দিষ্ট পাপের জন্য বান্দা অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। কিন্তু একই পাপ বারবার করা এবং প্রতিবারই তওবা করা; এমন তওবা দয়াময় আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না, অর্থাৎ সেই তওবা কবুল হবে না। সুতরাং বান্দাকে সতর্ক থাকতে হবে তওবা করার পর পাপের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।
লেখক : সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, পিইউবি
বিডি প্রতিদিন/এমআই