ইসলামের তৃতীয় খলিফা ছিলেন নবীজি (সা.)-এর অন্যতম বিশিষ্ট সাহাবি উসমান ইবনে আফফান (রা.)। শুধু তা-ই নয়, সময়ের ব্যবধানে তিনি একে একে নবীজি (সা.)-এর দুই কন্যা রুকাইয়া (রা.) ও উম্মে কুলসুম (রা.)-এর স্বামী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। যার কারণে তাঁকে যিন্নুরাইন বলা হতো। তিনি ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবির একজন।
ওহির লেখক ও ইসলামের প্রথম দুই খলিফার উপদেষ্টা। (তারিখুল খুলাফা, ১/১১৯; আল-ইসাবাহ, ৪/৩৭৭, ৫৪৬৪)
তাঁর অন্যতম একটি উপাধি ছিল ‘গনি’। ‘গনি’ শব্দের অর্থ হলো ধনী। তিনি ছিলেন আরবের নামকরা ধনী ব্যক্তি।
তবে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও জাহেলি যুগেও তিনি কখনো কোনো অনৈতিক কাজে লিপ্ত হননি। ইসলামের সংকটময় সময়ে তিনি বিপুল অর্থ ব্যয় করে ইসলামের উপকার সাধন করেন, যার নজির আর কোনো সাহাবির নেই।
(আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, ১/৩৯-৪০, ৪৬)
তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে মুসলিম বাহিনীর বিপুল অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন দেখা যায়। সে সময় উসমান বিন আফফান শাম অঞ্চলের উদ্দেশে এমন একটি বাণিজ্য কাফেলা প্রস্তুত করছিলেন, যার মধ্যে ছিল পালান ও গদিসহ ২০০ উট এবং ২০০ উকিয়া রৌপ্য (যার ওজন ছিল প্রায় ২৯ কেজি)।
এর সব কিছুই তিনি সদকা করে দেন যুদ্ধের জন্য। এরপর তিনি হাওদাসহ আরো ১০০ উট দান করেন। এর পরও পুনরায় তিনি এক হাজার (আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের) স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এসে নবী কারীম (সা.)-এর কোলের ওপর ঢেলে দেন। রাসুল (সা.) স্বর্ণমুদ্রাগুলো উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ‘আজকের পর উসমান যা কিছু করবে তাতে তার কোনোই ক্ষতি হবে না। এর পরও উসমান আবার দান করেন এবং আরো সদকা করেন। (আর রাহিকুল মাখতুম)
মদিনায় হিজরতের পর মুসলমানদের মধ্যে পানিসংকট দেখা দেয়, তখন মুসলমানরা রুমা নামক এক ইহুদির কাছ থেকে উচ্চমূল্যে পানি কিনতে বাধ্য হয়। সেই কূপটির নাম ছিল রুমা কূপ। উসমান (রা.) ইহুদির কাছ থেকে রুমা কূপটি ৩৫ হাজার দিরহামের বিনিময়ে কিনে কিয়ামত পর্যন্ত সব মুসলমানের জন্য ওয়াকফ করে দেন। তার কেনা সেই কূপ ও কূপের পাশে গড়ে ওঠা খেজুরবাগান আজও অক্ষত আছে।
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পরে কূপ ও এ বাগান কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিবছর বাগান থেকে উৎপাদিত খেজুর বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জিত হয়, তার অর্ধেক এতিম-গরিবদের দান করা হয়। অর্ধেক হজরত উসমান (রা.)-এর নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হতে থাকে। অ্যাকাউন্টটি পরিচালনা করে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া তিনি নবীজি (সা.)-এর জীবদ্দশায় মসজিদে নববীদের সম্প্রসারণের জন্য জমি কিনে দেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৭০৩)
ঐতিহাসিকদের মতে, খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর যুগে মানুষের ওপর তীব্র খরা ও দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল। পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন হয়েছিল যে লোকজন খলিফা আবু বকর (রা.)-এর কাছে গিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! আকাশ থেকে বৃষ্টি নামছে না, জমিন কোনো ফসল উৎপন্ন করছে না, মানুষ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। আমরা কী করব?’
আবু বকর (রা.) বললেন, ‘তোমরা ফিরে যাও এবং ধৈর্য ধরো। আমি আশা করি, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বস্তির পথ খুলে দেবেন।’
দিনের শেষ ভাগে খবর এলো যে উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর এক কাফেলা শাম থেকে মদিনায় এসে পৌঁছেছে। যখন কাফেলাটি এলো, লোকজন তাকে স্বাগত জানাতে বের হয়ে গেল। দেখা গেল এটি এক হাজার উট, যেগুলো বোঝাই করা ছিল ঘি, তেল ও ময়দা দিয়ে। কাফেলাটি এসে উসমান (রা.)-এর দরজার সামনে থামল। পণ্যগুলো তাঁর বাড়িতে নামানোর পর শহরের ব্যবসায়ীরা সেখানে উপস্থিত হলো।
উসমান (রা.) তাদের বলেন, ‘তোমরা কী চাও?’ ব্যবসায়ীরা বলল, ‘আপনি তো জানেন আমরা কী চাই। আপনি আমাদের এ পণ্য বিক্রি করুন, কারণ আপনি জানেন মানুষ চরম খাদ্যসংকটে আছে।’
উসমান (রা.) বলেন, ‘আমি যে দামে এগুলো কিনেছি, তার ওপর তোমরা আমাকে কত লাভ দেবে?’ তারা বলল, ‘এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম।’ উসমান (রা.) বললেন, ‘এর চেয়ে বেশি আমাকে অন্য কেউ দিয়েছে।’ তারা বলল, ‘চার দিরহাম!’ উসমান (রা.) বললেন, ‘এর চেয়ে বেশি দিয়েছে।’ ব্যবসায়ীরা বলল, ‘আমরা (এক দিরহামের বিপরীতে) তোমাকে পাঁচ দিরহাম লাভ দেব।’ উসমান (রা.) বললেন, ‘আমাকে অন্য কেউ এর চেয়েও বেশি দিয়েছে।’ তারা অবাক হয়ে বলল, ‘মদিনায় আমরা ছাড়া আর কোনো ব্যবসায়ী এখানে আসেনি। তবে আপনাকে আমাদের চেয়ে বেশি কে দিল?’
উসমান (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে প্রতিটি দিরহামের বিপরীতে ১০ দিরহাম দিয়েছেন, একটি সওয়াবের বিনিময়ে ১০টি সওয়াব। তোমাদের কি এর চেয়ে বেশি কিছু আছে?’ তারা বলল, ‘না।’ উসমান (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি—এই উটগুলো যা নিয়ে এসেছে (উটে বোঝাই করা সমস্ত মালপত্র), সব আমি মুসলিমদের দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্য সদকা করে দিলাম।’ এরপর উসমান ইবনে আফফান (রা.) পণ্যগুলো বিতরণ করতে লাগলেন। মদিনার কোনো দরিদ্র লোক অবশিষ্ট রইল না যে তার এবং তার পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাবার পায়নি। (ফিকহুত তাজেরিল মুসলিম, পৃ. ৩১)