সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন বুদ্ধিজীবী কবি শরিয়ত নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। এক অনুষ্ঠানে তাঁকে বলতে শোনা গেছে, শরিয়াহ মানুষের অধিকার হরণ করে। শরিয়তে কোরআনবিরোধী অনেক কিছু আছে। তাঁর এমন বিতর্কিত মন্তব্যে প্রাজ্ঞ আলেমদের হতবাক করেছে, ব্যথিত করেছে।
ইসলামের প্রায়োগিক দিকগুলো ও বিধি-বিধানকে শরিয়ত বলা হয়। শরিয়তের প্রধান উৎস কোরআন ও সুন্নাহ। কোরআন ও সুন্নাহই শরিয়তের প্রধান ভিত্তি। কোরআন ও শরিয়তকে মুখোমুখি দাঁড় করানো নিতান্তই বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া বলেন, “শরিয়তে কোরআনবিরোধী অনেক বিষয় আছে—অভিযোগটি ডাহা মিথ্যা। যারা শরিয়তকে কোরআনবিরোধী বলেছে, তাদের সমস্যা সম্ভবত দুটি। প্রথমত তারা হয়তো শরিয়তের উৎস সম্পর্কে অজ্ঞতা বা শরিয়াফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞতাবশত এসব বলছে। কেননা শরিয়তের প্রধান উৎসই হলো কোরআন ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ।
তাই এগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু শরিয়ত হতে পারে না। নতুবা আল্লাহর কোরআনকে নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে সেটার সঙ্গে শরিয়তের বিরোধিতার ভিত্তিহীন চিন্তা পোষণ করে। এটি মূলত ইচ্ছা করে ভুল ধরার মানসিকতা নিয়ে কথা বলা। বিতর্কিত মন্তব্যকারী ভ্রান্ত মতবাদ ‘লালনবাদে’ বিশ্বাসী বলে জানা যায়। ফলে তাঁর এমন মন্তব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।”
আর তরুণ আলেম, গবেষক ও সংগঠক মুফতি রেজাউল করীম আবরারও এমন বক্তব্য প্রদানকারীর উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘কোরআন ও সুন্নাহ দিয়েই তো শরিয়ত। শরিয়তের কোনো বিধানই কোরআন-সুন্নাহর বাইরে নয়। যিনি মনে করছেন শরিয়ার অনেক বিধান কোরআনবিরোধী, উনি না বোঝেন কোরআন, না বোঝেন শরিয়ত। এটা হয়তো তাঁর অজ্ঞতা, নয়তো তাঁর উদ্দেশ্য ভালো নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখানে যাঁরা মনে করেন শরিয়াহ কোরআনবিরোধী, তাঁরা কোরআনের ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে নিজের যুক্তি ও ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দেন। তাঁর ব্যাখ্যা ও যুক্তির সঙ্গে শরিয়ার বিধান না মিললে মনে করেন শরিয়াহ কোরআনবিরোধী হয়ে গেছে! মূলত এই শ্রেণির মানুষ কোরআনের ব্যাখ্যায় সালাফের চিরায়ত রীতি ও পদ্ধতি ত্যাগ করেছে এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। এর মাধ্যমে তারা হেদায়েতের পরিবর্তে বিভ্রান্তির পথ বেছে নিয়েছে। তারা শুধু নিজেরাই বিভ্রান্ত হয়নি, বরং তা সমাজেও ছড়িয়ে দিচ্ছে।’
অধ্যাপক যাকারিয়া চমৎকারভাবে কোরআন ও শরিয়াহর সম্পর্ক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘কোরআন ও শরিয়তের মধ্যে সম্পর্কে হচ্ছে খাঁটি ২৪ ক্যারেট গোল্ডের বার এবং তা থেকে গ্রহণ করা অলংকারের মতো। স্বর্ণ না থাকলে যেমন অলংকারের মূল্য নেই, তেমনি অলংকার না বানালে শুধু ক্যারেট গোল্ডের বারও ব্যবহার করা যায় না। তাই ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে তার শরিয়ত। কোরআন দিয়েই শরিয়তের পত্তন হয়েছে।’ আল্লাহ বলেন, ‘তারপর আপনাকে আমরা শরিয়তের ওপর রেখেছি, সুতরাং আপনি শরিয়তের অনুসরণ করুন।’
(সুরা : জাসিয়া, আয়াত : ১৮)
আল্লাহ মানবজাতিকে দ্বিন ও শরিয়ত দান করেছেন ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির জন্য। শরিয়তই মানুষের সব অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। কেননা শরিয়তের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে পাঁচটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়। তা হলো, দ্বিনের সুরক্ষা, জীবনের সুরক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের সুরক্ষা, সম্ভ্রম ও বংশধারার সুরক্ষা এবং সম্পদের সুরক্ষা। এর মাধ্যমে মূলত ইসলাম মানবজীবনে সব মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়াকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘শরিয়াহ মানুষের অধিকার হরণ করে’ এমন কথা বলার সুযোগ আছে কি? তিনি বলেন, ‘মানুষের অধিকার কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হচ্ছে সেটাই মূল কথা। সাধারণত অধিকার বলতে বোঝায় প্রত্যেক মানুষ জন্মসূত্রে যেসব মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। যদি মানুষের অধিকার দ্বারা এগুলোই উদ্দেশ্য হয়, তবে ইসলামী শরিয়া মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না, বরং তা মানুষের অধিকার রক্ষা করে।’
কোরআন ও শরিয়তকে যারা মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং বলে, শরিয়তে কোরআনবিরোধী অনেক কিছু আছে তাদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. মুহাম্মাদ আবু বকর যাকারিয়া বলেন, প্রতিটি আইনের ব্যাখ্যা তার নিজস্ব ধারার লোকেরাই প্রদান করে থাকে। তাই শরিয়াহ আইনের উৎসর ব্যাখ্যা কেবল শরিয়াহ আইনে অভিজ্ঞ লোকেরাই প্রদান করার যোগ্যতা রাখেন। অন্য কেউ সেটা করলে অবশ্যই অনধিকার কাজ বিবেচিত হবে। আজ পর্যন্ত কোনো মুসলিম শরিয়ত বিশেষজ্ঞ শরিয়তকে কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেননি। যিনি শরিয়তের সঙ্গে কোরআনের সাংঘর্ষিক অবস্থানের কথা বলেছেন তাঁর ব্যাপারে ইসলাম বলে—এটিরও দ্বিন রক্ষার নীতি অনুসারে বিচার হবে। সেটা অনুসারে প্রথমেই তাঁর ব্যাপারে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে, তাঁকে প্রথমে এ ব্যাপারে ইসলামী বিধান জানাতে হবে। তারপর তাঁর সন্দেহের ব্যাপারে আলোচনা করে যোগ্য শরিয়ত স্কলারদের মাধ্যমে সমাধান করার সুযোগ দেওয়া হবে। যখন জানা যাবে যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বাসে আঘাত হানতে চলেছেন, তখন তাঁকে শাসকের পক্ষ থেকে তাঁর ঈমানের ব্যাপারে রায় ঘোষণা করা হবে। আর সেটার বিচারকার্য কোর্টের নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হবে।
একই প্রশ্নের উত্তরে মুফতি রেজাউল করীম আবরার বলেন, ‘ইসলাম ১৪০০ বছরে কখনো এত অসহায় হয়নি যে কোরআন বা শরিয়াহসংক্রান্ত কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা একজন লালনবাদী কবির কাছ থেকে নিতে হবে। বিশেষত যাঁর চিন্তা-ভাবনার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই এবং নিজেও পারস্পরিক বিরোধী কথা বলে বেড়ান।’ তবে তিনি বিতর্কিত মন্তব্যকারীর ভুল ভাঙানোর প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘যদি তিনি জানতে আগ্রহী হন, আমরা তাঁকে জানাতে প্রস্তুত। আর যদি শরিয়ার কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি আমাদের সঙ্গে ডিবেটও করতে চান, তাঁর ভুল ভেঙে দেওয়ার জন্য আমরা ডিবেট করতেও প্রস্তুত আছি।’
উভয় আলেম ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা জনসাধারণকে বলব, কোরআন ও শরিয়তের ব্যাপারে হক্কানি আলেমদের কথা ও ব্যাখ্যা অনুসরণ করতে হবে। যারা সালাফে পথ ও পদ্ধতি ত্যাগ করে ভিন্ন পথে চলে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে গেছে তাদের পরিহার করতে হবে। নতুবা দ্বিনদারির ক্ষেত্রে আমাদের সীমাহীন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।’
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন