পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সন্দেহজনক লেনদেনের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের সাড়ে ১০ মাসে (২০২৪ সালের জুলাই থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) ২৭ হাজার ১৩০টি সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) পাওয়া গেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭৯ শতাংশ বেশি। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে তিন শ সংসদ সদস্য, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই কাজের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বিএফআইইউয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।
সংস্থাটি জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করা হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ১০৬। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সংস্থাটি বলছে, গত বছরের জুলাই মাসের পর থেকে রিপোর্টিংয়ের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ থেকে ১৮-২০ বিলিয়ন বা এক হাজার ৮০০ কোটি থেকে দুই হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে (বাংলাদেশি টাকায় দুই লাখ ১৯ হাজার ৬০০ কোটি থেকে দুই লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা)। একজনই ৩৫০টি বাড়ি কিনেছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে। এসব ঘটনা উদঘাটন করা গেছে। দিন দিন এই অর্থের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হবে, এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য নতুন। আমরা কেউ এ ধরনের কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পাচারের অর্থ ফেরত আনার কাজ গতিশীল করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সে জন্য আইনে পরিবর্তন আনা হবে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে।’
আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, ‘পাচারের অর্থ ফেরত আনতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে। এরই মধ্যে বিদেশে একজনের সম্পদ জব্দ হয়েছে। সামনে আরো সম্পদ জব্দ হবে। আমাদের উদ্দেশ্য, পাচারকারীদের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে আদালতের বাইরে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করা যায়। কাউকে জেলে নিয়ে হয়রানি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারো ব্যবসা বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কারো ব্যবসা বন্ধ করিনি। যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, তা অন্য কারণে হয়েছে।’
এ ছাড়া বিএফআইইউ গত অর্থবছরে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মোট এক হাজার ২২০টি তথ্য বিনিময়ও হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩.৯১ শতাংশ বেশি।
বিএফআইইউয়ের প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, অর্থপাচার ও হুন্ডি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও লেনদেন ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্রবণতা। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কাজ চলছে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে। এ কাজে পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক।
বিএফআইইউয়ের প্রধান বলেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার লক্ষ্যে সংস্থাটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, তদন্তকারী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। বিশ্বব্যাংকের এসটিএআর, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডোজ, আইএসিসিসি ও আইসিএআরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হওয়ায় সময় লাগবে।
সভায় বিএফআইইউয়ের পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, অর্থপাচার ধরা ও উদ্ধার করা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা চলতেই থাকবে। গত বছরের জুলাই মাসের পর বিএফআইইউয়ের কাজ কয়েক গুণ বেড়েছে। সন্দেহজনক প্রতিবেদন অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন পাঠানো বেড়েছে চার গুণ।
বিডি প্রতিদিন/আশিক