পয়লা মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’। উৎপাদনে যিনি শ্রমের জোগান দেন তিনি শ্রমিক এবং যিনি মূলধন জোগান দেন তিনি মালিক। পবিত্র কোরআনে শ্রমিকের যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে
‘ভালো সে কর্মচারী হবে নিশ্চয়
যে শক্তিশালী ও বিশ্বাসী রয়।’
(কাব্যানুবাদ, সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৬)
‘জীবনের জন্য জীবিকার্জন’ একটি ইবাদততুল্য কর্তব্য।
কর্মের চেতনায় জীবন সাজানোই মহান আল্লাহর নির্দেশ, ‘অতএব, যখনই অবসর (সুযোগ) পাও পরিশ্রম করো...।’
(সুরা : ইনশিরাহ, আয়াত : ৭)
কর্মবিমুখতা, পরমুখাপেক্ষিতা বা ভোগবাদিতা নয়, বরং শ্রমই ছিল নবী-রাসুলদের আদর্শ। নুহ (আ.) কাঠের কাজের মাধ্যমে, ইদ্রিস (আ.) পোশাকশিল্পে, দাউদ (আ.) সমরাস্ত্র তৈরিতে, মুসা (আ.) মেষ পালন আর প্রিয় নবী (সা.) ব্যবসায় পরিচালনা ও সৈনিকের কঠোর সাধনার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। নবী-রাসুলদের কর্মময় জীবনের বিবরণ দিয়ে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ কোনো নবী পাঠাননি, যিনি ছাগল চড়াননি।
জিজ্ঞাসা করা হলো আপনিও কি তাদের মতো? তিনি বলেন, হ্যাঁ আমিও কয়েক কিরাতের (দিরহাম) বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চড়াতাম।’ (বুখারি)
প্রিয় নবী (সা.) চাচার বকরি পালন করেছেন, জীবিকার্জন ও ব্যবসায়ের উদ্দেশে ১২ বছর বয়সে তাঁর চাচার সঙ্গে সিরিয়া গিয়েছিলেন। প্রিয় নবী (সা.) বিবি খাদিজার (রা.) ব্যবসায় পরিচালনা করেছেন এবং যুদ্ধের ময়দানে মোবারক হাতে পরিখা খনন করেছেন। তিনি (সা.) বলতেন, ‘আল কাসিবু হাবিবুল্লাহ’ অর্থাৎ শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু।
বলা হয় ‘হরকতেই বরকত’। সাহাবিদের অনেকেই ছিলেন ব্যবসায়ী বা অন্যান্য কর্মতৎপরতায় স্বাবলম্বী। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বুনন শিল্পে, ইমাম জাসসাস দেয়াল রং করে, ইমাম কুদুরি হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসায় আর দিল্লির বাদশাহ নাসিরুদ্দিন পবিত্র কোরআন লিপিবদ্ধ করে বিনিময় মূল্য নিয়ে ও টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। অপদার্থের মতো অলস জীবনযাপন ইসলামের শিক্ষা নয়। আবু দাউদ শরিফের একটি হাদিসে জানা যায়, প্রিয় নবী (সা.) ভিক্ষুকের হাতকে শ্রমিকের হাতে
রূপান্তরিত করেছিলেন।
মানুষের আয়-রোজগারের প্রয়াস এবং জীবনের গতিশীলতার সব সাধন পদ্ধতি ও কর্মবৃত্তির পরিভাষা ‘শ্রম’। অর্থনীতির দৃষ্টিতে ‘শারীরিক বা মানসিক যেকোনো প্রকারের তৎপরতা, যা আংশিকভাবে আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো উপকারের জন্য করা হয় তাই শ্রম।’ (অধ্যাপক মার্শাল)
এ জন্যই দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সব শ্রম ও শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণে ইসলাম অত্যন্ত সোচ্চার। শ্রমিকের শ্রম-ঘাম মানুষের জীবন চলার গতিকে করে স্বচ্ছন্দ, তাই ওদের স্বার্থ সংরক্ষণ একটি আমানত। প্রিয় নবীর (সা.) হুঁশিয়ারি ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনবেন, তার মধ্যে একজন ওই ব্যক্তি, যে অধীনকে পরিশ্রম করিয়ে পূর্ণ কাজ আদায় করেও তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করেনি।’ (বুখারি)
শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় প্রিয় নবী (সা.) খুবই সতর্ক ছিলেন। তিনি (সা.) বলেন, ‘তারা তোমাদের ভাই (মালিক-শ্রমিক), আল্লাহ তাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করেছেন...সাধ্যাতীত কাজে তাদের বাধ্য করবে না।’ (বুখারি)
শ্রম ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকের অধিকার পরস্পর সম্পৃক্ত। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘শ্রমিকের কাজ শেষ হওয়া মাত্র তার পারিশ্রমিক দিয়ে দেবে।’ (নাসায়ি ও ইবনে মাজাহ)
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম ইবাদততুল্য পবিত্র বিষয়। জীবিকা প্রসঙ্গে আল-কোরআনে ‘হালালান তাইয়্যেবা’ (বৈধ-পবিত্র) পথকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং ঈমান ও সৎকর্মের সুফল হলো ‘রিজকান কারিমা’ বা ‘সম্মানজনক জীবিকা’।
বস্তুত মানুষের জীবন কিছু কাজের সমষ্টি মাত্র। শ্রম সাধনা মানুষের জীবনসংগ্রামের অংশ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলে যেয়ো না।’
(সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)
জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সূক্ষ্ম-সুচারু ব্যবহারের অভিজ্ঞতা মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। শ্রম সাধনায় মানুষের মূল্যবান প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ্য হয়ে ওঠে। তাই তো মানুষ কাজ করে, শ্রমদান করে শ্রান্তিতে ক্লান্ত-ক্লিষ্ট হয় এবং এরই যথার্থ প্রতিদানে সে প্রশান্তির পরাগরেণুতে সুরভিত হয়ে ওঠে। পরিশ্রম, সাধনা ও কর্মেই মানুষের পরিণতি ঠিক হয়। কবির ভাষায়—
‘কর্মেই গড়ে মানুষের জীবনসত্তা
কর্মেই বণ্টিত হয়—জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা।’ (আল্লামা ইকবাল)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন