ইসলামের আগমন ঘটেছিল পবিত্র মক্কা নগরীতে এবং এর বিকাশ ঘটেছিল মদিনা নগরীতে। মুসলিম সভ্যতা ও জ্ঞানচর্চার সোনালি যুগ এসেছিল বাগদাদ নগরীতে। এভাবে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তারে প্রাচীন মুসলিম নগরগুলো বহুমুখী অবদান রেখেছিল। মুসলিম সভ্যতার বিকাশে অবদান রাখা এমন ১০ প্রাচীন নগরীর পরিচয় তুলে ধরা হলো—
১. মদিনা : মদিনায় মানুষের বসতি গড়ে ওঠে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে।
একসময় তা পারস্য সম্রাটের অধীনে ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে ইয়েমেন থেকে আরবরা মদিনায় এসে বসবাস শুরু করে। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমনের পূর্বে নগরীটি নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। লোকেরা তখন একে ইয়াসরিব বা রোগাক্রান্ত বলত।
মহানবী (সা.) আগমনের পর নগরীর নাম হয় মদিনাতুর রাসুল। আর তা লাভ করে অনন্য মর্যাদা ও গৌরব। পবিত্র এই নগরীতেই প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটে। উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর শাসনামল পর্যন্ত মদিনা ছিল ইসলামী খিলাফতের রাজধানী।
মদিনায় মহানবী (সা.)-এর রওজা হওয়ায় তা সব সময় মুসলিম উম্মাহ ও মুসলিম শাসকদের যত্ন ও ভালোবাসা লাভ করেছে।
২. বসরা : দক্ষিণ ইরাকের বন্দর নগরী বসরার গোড়াপত্তন হয়েছিল ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে। খলিফা ওমর (রা.)-এর নির্দেশে সেনাপতি উতবা ইবনে গাজওয়ান (রা.) বসরা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক এই নগরীর যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি সেনাঘাঁটি হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তা মুসলিম সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
আরবি সাহিত্যের কিংবদন্তি নাবিক সিন্দাবাদ বসরা থেকেই তাঁর সমুদ্র যাত্রা শুরু করেছিলেন। হাসান বসরি (রহ.), রাবেয়া বসরি (রহ.) ও গণিতবিদ ইবনে হাইসাম বসরা নগরীর বাসিন্দা ছিলেন।
৩. কুফা : ইরাকের বিখ্যাত নগরী কুফার গোড়াপত্তন হয় ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। খলিফা ওমর (রা.)-এর নির্দেশে সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) কুফা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ইরাক অঞ্চলের প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র হিসেবে কুফার যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিকাশে কুফা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খলিফা আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) কুফা নগরীকে ইসলামী খিলাফতের রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন। কুফা নগরীতে আলী (রা.)-এর কবর থাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এই শহরকে পবিত্র জ্ঞান করে। ঐতিহাসিক এই নগরী বহু মুসলিম মনীষীর স্মৃতি ধারণ করে আছে। তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন আসবাত ইবনে মুহাম্মাদ, মুসলিম ইবনে আকিল, ইমাম আবু হানিফা, সুফিয়ান সাওরি, আল কিন্দি, জাবের ইবনে হাইয়ান, আলকামা ইবনে কায়েস, ইমাম দাউদ জাহেরি, মাসরুক (রহ.) প্রমুখ।
৪. বাগদাদ : আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর আল মানসুর ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। আব্বাসীয় খিলাফতের সময়ে বাগদাদ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর। শত শত বছর ধরে বাগদাদ ছিল মুসলিম বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র। বাগদাদে স্থাপিত বায়তুল হিকমাহ মুসলিম বিশ্বে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণে অসামান্য অবদান রাখে। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলীয় বাহিনী এবং ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বাহিনী বাগদাদে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ইরাকের এই রাজধানী শহরে ইতিহাসের বিখ্যাত বহু মুসলিম মনীষীর জন্ম হয়েছিল। যেমন—ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, আল খাওয়ারিজমি, আল জাহিজ, আল মাওয়ার্দি, আবু তাম্মাম, আবদুল কাদের জিলানি, মানসুর হাল্লাজ (রহ.) প্রমুখ।
৫. দামেস্ক : সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের গোড়াপত্তন হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে। রোমান আমলেই শহরটি লেভেন্ট অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ শহরের পরিণত হয়। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দামেস্ক জয় করে। উমাইয়া খিলাফতের সময় এটিই ছিল ইসলামী খিলাফতের রাজধানী। এই সময় দামেস্ক মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে বহু বিখ্যাত মুসলিম মনীষীর জন্ম হয়। যেমন—ইমাম শাফেয়ি, আল্লামা ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল জাওজি, ইবনে কাসির, ইমাম জাহাবি (রহ.) প্রমুখ।
৬. বুখারা : প্রাচীন খোরাসান অঞ্চলের বিখ্যাত নগরী বুখারা। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে বুখারা নগরীর গোড়াপত্তন হয়। উমাইয়া সেনাপতি কুতাইবা বিন মুসলিম ৭১২ খ্রিস্টাব্দে বুখারা জয় করেন। সামানিদ শাসকরা বুখারাকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে। প্রাচীন সিল্ক রোডের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ইসলামপূর্ব সময় থেকে বুখারা একটি ধনী ও সমৃদ্ধ নগরী ছিল। মুসলিম শাসনাধীন হওয়ার পর বুখারায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। ঐতিহাসিক এই শহরে জন্ম নেওয়া মনীষীদের ভেতর উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন ইমাম বুখারি, ইমাম বাজ্জার, ফুজাইল ইবনে ইয়াজ, আবু আবদুল্লাহ সামারকান্দি, হাফেজ সিরাজি ও ইমাম মাতুরিদি (রহ.)।
৭. কায়রো : আরব ও আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর কায়রো। প্রাচীন এই নগরীর গোড়াপত্তন হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি আমর বিন আস (রা.) কায়রো জয় করেন। মুসলিম শাসনাধীন হওয়ার পর কায়রো আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফাতেমি শাসকরা কায়রোকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে। কায়রো অবস্থিত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ বিদ্যাপীঠ। কায়রোর বিখ্যাত কয়েকজন মনীষী হলেন ইমাম সুয়ুতি, ইমাম রাজি, ইমাম কুশাইরি, তাকিউদ্দিন মুকরিজি, ইবনে মুফলিহ, মুহাম্মদ আবদুল্লাহ রাফেয়ি (রহ.) প্রমুখ।
৮. গ্রানাডা : আধুনিক স্পেনের শহর গ্রানাডা অঞ্চলে মানব বসতি গড়ে ওঠে খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমানরা এখানে নগর প্রতিষ্ঠা করে। তবে আধুনিক ও সমৃদ্ধ শহর গ্রানাডার যাত্রা শুরু হয়েছিল মুসলমানের হাত ধরে। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী স্পেন জয় করে, বিশেষ করে নাসেরি রাজবংশের সময়। তখন শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের বিচারে গ্রানাডা ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শহর। এই শহরের বিখ্যাত কয়েকজন মনীষী হলেন আবুল আব্বাস ইবনে রুমিয়া, ইবনে বাজাহ, ইবনে খালদুন, ইবনুল ওয়াফা প্রমুখ।
৯. কর্ডোভা : মুসলিম স্পেনের আরেকটি বিখ্যাত শহর কর্ডোভা। কর্ডোভা ছিল আল আন্দালুসের রাজধানী। মুসলিম আমলে এটিও অত্যন্ত সমৃদ্ধ শহর ছিল। এই শহরে মুসলিমরা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই শহরের বিখ্যাত কয়েকজন মনীষী হলেন ইমাম কুরতুবি, ইবনে রুশদ, আল জারকানি, আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে হাসান, আল জাহরাভি, আরিব ইবনে সাআদ প্রমুখ।
১০. দিল্লি : ভারতের রাজধানী দিল্লির ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। পৌরাণিক পাণ্ডব রাজাদের রাজধানী বর্তমান দিল্লির কাছেই ছিল বলে ধারণা করা হয়। রাজধানী ও আধুনিক শহর হিসেবে দিল্লির যাত্রা শুরু হয় মুসলিম শাসনামলে। সুলতানি ও মোগল আমল মিলে দিল্লি মুসলমানদের রাজধানী ছিল প্রায় সাত শ বছর। এই সময় দিল্লি শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার শীর্ষ চূড়ায় আরোহণ করে। এই শহরের বিখ্যাত কয়েকজন মুসলিম মনীষী হলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি, আমির খসরু, মোল্লা আসাদ গিলানি, মোল্লা নাসরুল্লাহ, সাইয়েদ সুলাইমান নদভি (রহ.) প্রমুখ।
তথ্যঋণ : দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ওয়েবসাইট
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন