রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ অবসানে হোয়াইট হাউজের শান্তি পরিকল্পনাকে ঘিরে কিয়েভ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারাতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমিরি জেলেনস্কি।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেনকে কঠিন পছন্দের মুখোমুখি হতে পারে: ‘হয় আত্মমর্যাদা হারানো অথবা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকে হারানোর ঝুঁকি’। তিনি বলেন, এটি তার দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
ব্যাপকভাবে ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি পরিকল্পনায় এমন কিছু বিষয় আছে যা কিয়েভ আগেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর মধ্যে আছে পূর্বাঞ্চলীয় কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া, সশস্ত্র বাহিনীর আকার কমিয়ে আনা এবং নেটোতে যোগ না দেওয়ার অঙ্গীকার করা।
এসব প্রস্তাব রাশিয়ার পক্ষে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, এই পরিকল্পনাটিই শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হতে পারে।
শুক্রবার সিকিউরিটি কেবিনেটের বৈঠকে পুতিন জানান, মস্কো পরিকল্পনাটি পেয়েছে, তবে ক্রেমলিনের সঙ্গে এর বিস্তারিত এখনো আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, রাশিয়া নমনীয়তা দেখাতে প্রস্তুত কিন্তু একই সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্যই প্রস্তুত আছে।
ওদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, জেলেনস্কিকে পরিকল্পনাটি পছন্দ করতে হবে, অন্যথায় ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ চলতে থাকবে।
ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আছে। এছাড়া ওয়াশিংটন গোয়েন্দা তথ্যও সরবরাহ করে।
কিয়েভে প্রেসিডেন্সিয়াল অফিসের সামনে দেয়া ১০-মিনিটের ভাষণে জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেন, ‘আমাদের দুর্বল করতে, বিভক্ত করতে...অনেক চাপের মুখে পড়বে ইউক্রেন’। তিনি বলেন, ‘শত্রুরা ঘুমিয়ে নেই’।
তিনি বলেন, তারা আমেরিকান এবং অন্য অংশীদারদের সাথে শান্তভাবে কাজ করছেন এবং প্রস্তাবিত পরিকল্পনার বিকল্পও তুলে ধরেছেন।
জেলেনস্কি জানান, তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎসের কাছ থেকে অব্যাহত সমর্থনের আশ্বাস পেয়েছেন।
স্যার কিয়ের শুক্রবার বলেছেন, ইউক্রেনের সহযোগীরা সবার জন্য একটি ন্যায্য ও টেকসই শান্তির জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় জি-২০ শীর্ষ বৈঠকের আগে তিনি বলেছেন, তিনি ও অন্য বিশ্ব নেতারা ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা সমর্থনে প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করবেন এবং দেখবেন কীভাবে আলোচনার পরবর্তী ধাপের জন্য এই পরিকল্পনাকে শক্তিশালী করা যায়।
ট্রাম্প ওই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না। তিনি সেখানে শ্বেতাঙ্গদের নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছেন।
আলাদাভাবে জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও আর্মি সেক্রেটারি ড্যান ড্রিসকলের সাথে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ অবসানে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার প্রতি ইউক্রেন সবসময় শ্রদ্ধাশীল।
ওয়াশিংটনে ট্রাম্প ইউক্রেনকে অল্প সময়ের মধ্যে রাশিয়ার কাছে আরও ভূখণ্ড হারানোর বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে ইউক্রেনকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়াই যথাযথ, তবে সবকিছু ঠিকমতো চললে এ সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে।
হোয়াইট হাউজে শুক্রবার ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমরা মনে করি শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি উপায় আছে। তিনি আরও বলেন, ‘জেলেনস্কিকে এটি অনুমোদন করতে হবে’।
ওয়াশিংটন পরিকল্পনাটি দ্রুত গ্রহণের জন্য কিয়েভকে চাপ দিচ্ছে। সপ্তাহের শুরুতে পেন্টাগনের একজনের সিনিয়র কর্মকর্তাকে কিয়েভে পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার পুতিন যুদ্ধ অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। সেনা কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে সামরিক ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কাজ ও লক্ষ্য আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করা’।
যুক্তরাষ্ট্রের ২৮-দফা শান্তি পরিকল্পনা এমন সময় বাইরে এসেছে যখন দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে কিছু ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সাফল্যের দাবি করছে রাশিয়া।
অন্যদিকে, শীর্ষ কিছু কর্মকর্তার প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ নিয়ে দেশে সংকটের মুখে আছেন জেলেনস্কি।
ওদিকে, শান্তি প্রস্তাবটি তৈরির সময় ইউক্রেনকে উপেক্ষার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে হোয়াইট হাউজ। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং রুশ প্রতিনিধি কিরিল দিমিত্রিভের বৈঠকের পর এটি বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পরিকল্পনাটি তৈরির সাথে সাথেই ইউক্রেনের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে দেখানো হয়েছে এবং তিনি এর বেশিরভাগের সাথেই একমত পোষণ করেছেন।
ফাঁস হওয়া ওই পরিকল্পনায় লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের একাংশ থেকে ইউক্রেনের সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চল থেকেও সরে আসতে হবে।
এছাড়া এতে খারসন ও ঝাপোরিজ্জিয়া অঞ্চলের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর একাংশ এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা হলো ইউক্রেনের সেনা সংখ্যা ৬ লাখে নামিয়ে আনা। আর ইউরোপিয়ান যুদ্ধবিমানগুলোর স্টেশন হবে প্রতিবেশী পোল্যান্ডে।
কিয়েভ নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি পাবে বলেও ওই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। যদিও এর বিস্তারিত দেয়া হয়নি।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, রাশিয়া প্রতিবেশী দেশে আগ্রাসন চালাবে না এবং নেটো আরও সম্প্রসারিত হবে না।
প্রস্তাবের খসড়া অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে রাশিয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার যুক্ত হবে এবং শক্তিশালী জি-৭ এ যুক্ত হলে এটি হবে জি-৮। রাশিয়ার দখলে থাকা কিংবা এর বাইরে থাকা-উভয় এলাকার ইউক্রেনীয়দের মধ্যে এসব প্রস্তাবের খবরে প্রতিবাদের সুর দেখা গেছে।
কিয়েভে নিহত এক সেনার স্ত্রী বলেন, ‘এটি কোনো শান্তি পরিকল্পনা নয়, এটা যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা’।
রাশিয়া এখন ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও রণাঙ্গনে এর সেনারা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত