কাশ্মীরের পাহেলগাঁও পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারতের কড়া প্রতিক্রিয়ার জবাবে আজ বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি)। এই বৈঠকে ভারতের একের পর এক কঠোর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান কীভাবে কৌশলগতভাবে সাড়া দেবে, তা নির্ধারণ করা হবে।
ভারতের নেওয়া কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা। এই চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে বহু বছর ধরে চলমান বিরোধের মধ্যেও টিকে ছিল।
ভারতীয় কর্মকর্তারা এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে, সীমান্তপারের সন্ত্রাসে সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান। তবে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ নাকচ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে এনএসসির এই বৈঠকের ডাক দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহবাজ শরিফ। বিষয়টি নিশ্চিত করেন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
বুধবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এ তথ্য জানান তিনি।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিক্রিয়াকে ‘অযৌক্তিক ও তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেন ইসহাক দার।
তিনি বলেন, এখনো কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি ভারত। বরং ঘটনার পরপরই তারা অযৌক্তিক উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এক বিবৃতিতে হতাহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় পর্যটকদের ওপর হামলায় প্রাণহানিতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। নিহতদের পরিবারদের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক এখন আবার ভয়াবহ রকমের উত্তেজনাপূর্ণ দিকে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা ও বালাকোট সংকটের পর এত বড় সংকট আর দেখা যায়নি। বিশেষ করে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত হওয়ায় ভবিষ্যতে বড় ধরনের পানি-সংক্রান্ত বিরোধ দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হলে উত্তেজনা কমানোর পথও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
ভারতজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়েছেন, যারা হামলার পেছনে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত জবাব আসবে। তিনি বলেন, শুধু হামলাকারী নয়, যারা পরিকল্পনা করেছে, তাদেরও আমরা খুঁজে বের করব।
পুলিশের তথ্যমতে, পাহেলগাঁওয়ের পর্যটন এলাকায় জঙ্গিরা গুলি চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে একজন নেপালের নাগরিক, বাকিরা ভারতীয়। এদিকে, হামলার সময় পাশের তাংমার্গ এলাকায় ভারতীয় বাহিনী ও সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের খবর পাওয়া গেছে। আরও একটি ঘটনায় বুধবার বারামুল্লায় ভারতীয় সেনাবাহিনী দুই জনকে গুলি করে হত্যা করেছে, যাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা হয়েছে।
বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে অনেক দেশ। সবার আগে সমবেদনা জানান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিন্দা জানান এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করেন। এদিকে, চীনের রাষ্ট্রদূত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে।
বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, এই হামলা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন একটি বড় সংকট তৈরি করতে পারে। ঘটনাটি ২০১৯ সালের সামরিক সংঘাতের পর সবচেয়ে গুরুতর।
‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’
এদিকে, জম্মু ও কাশ্মীরের পাহেলগাঁওয়ে ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি নিয়ে ভারতের ওপরই দায় চাপিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। তারা এই ঘটনাকে ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ, শত্রুপক্ষকে দোষী প্রমাণ করতে নিজেরাই হামলা চালিয়েছে— এমনটাই তাদের দাবি।
পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। আগে অনেকবারই এমন ঘটনার দায় পাকিস্তানের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে, কোনো প্রমাণ ছাড়াই। পাকিস্তানের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার (অব.) আহমেদ সাঈদ মিনহাস বলেন, হামলাটি ভারতের দখল করা অঞ্চলের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ভেতরে ঘটেছে। অথচ কোনো প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দোষারোপ করা হচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যম শুরু থেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ২০১৯ সালে পাকিস্তান ভারতীয় পাইলট অভিনন্দনকে নিরাপদে ফিরিয়ে দিয়ে দায়িত্বশীল ও সংযমী আচরণ করেছে। আমরা এমন আচরণে বিশ্বাসী।
অপর সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার (অব.) রশিদ ওয়ালি বলেন, হামলার পরপরই ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করতে শুরু করে। তাদের মিডিয়া ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়াতে থাকে। যদি ভারত এবারও আক্রমণের চেষ্টা করে, তবে বালাকোটের মতো ব্যর্থতা ও লজ্জায় পড়তে হতে পারে।
সাবেক সিনেটর ও পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্লেষক মুশাহিদ হুসেন সৈয়দ বলেন, এই ধরনের ঘটনার পরে পাকিস্তানকে দোষ দেওয়া ভারতের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এটি যেন ভারতের সরকারের ‘স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া’। তদন্ত না করেই তারা দোষ চাপায়, যেমনটা জাফর এক্সপ্রেস হামলা বা এখন পাহেলগাঁওয়ে ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে।
পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী বলেন, ভারতের কথিত ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ আসলে ইসলাম, পাকিস্তান এবং কাশ্মীরি জনগণকে অপমান করার একটি কৌশল। একই সঙ্গে তারা নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে চায়।
তিনি বলেন, ভারত সম্ভবত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে চাপ কমানোর জন্যও এই ধরনের ঘটনার আশ্রয় নিচ্ছে।
সূত্র : ডন, জিও নিউজ
বিডি প্রতিদিন/কেএ