বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকলে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ৪০ বছরের ভিটা থেকে এক কাপড়ে বের হতে হতো না। আর খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে এক কাপড়ে বের করা হয়েছিল বলেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, সংস্কার নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সংস্কার সংস্কার বলতে বলতে আট মাস কাটিয়ে দিলাম। বস্তুতপক্ষে এখনো পর্যন্ত সংস্কারের কী ঘটেছে সেটা কিন্তু মানুষ দেখেনি।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কসহ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আগামী নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ কারা?
কায়সার কামাল : সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণ কাকে ভোট দেবে সেটা জনগণের ইচ্ছার বিষয়। নির্বাচন যখন শুরু হবে তখনই বোঝা যাবে বিএনপির প্রতিপক্ষ কে? বিএনপির রাজনীতি মা, মাটি, মানুষের রাজনীতি। গত ১৬ বছর এই দেশের গণতন্ত্রের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তারেক রহমানসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এই ত্যাগকে যদি দেশের মানুষ মূল্যায়ন করে বিএনপি তাদেরকে স্বাগতম জানাবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল এনসিপির কার্যক্রমকে কীভাবে দেখছেন?
কায়সার কামাল : স্বাধীন বাংলাদেশে দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। সেই দলের একজন কর্মী হিসেবে আমরা যে কোনো দলকেই স্বাগত জানাব- যদি তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানসিকতা থাকে, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। আর তারা কিংস পার্টি কি না সেই সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দলগুলো ভিন্ন মত দিয়েছে। কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব?
কায়সার কামাল : সংস্কার নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সংস্কার সংস্কার বলতে বলতে আট মাস কাটিয়ে দিলাম। বস্তুতপক্ষে এখনো সংস্কারে কী ঘটেছে, তা মানুষ দেখেনি। বাংলাদেশে সংস্কার প্রথা চালু করেছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার পর দেশ যখন একদলীয় দুঃশাসনে ছিল তখন সংস্কারের মাধ্যমেই জনগণ তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে। বিএনপি এই সংস্কারের ধারাটা রক্ষা করতে চায়। বর্তমানে সংস্কারের নামে মুখে মুখে সংস্কার চলছে, কার্যত বাংলাদেশের মানুষ কোনো সংস্কার পাচ্ছে না। প্রকৃত সংস্কার তখনই হবে যখন একটা নির্বাচিত সংসদ থাকবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রোডম্যাপ চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব বলেছেন ‘অসন্তুষ্ট’। নির্বাচনি রোডম্যাপ আদায়ে বিএনপি কোন পথে যাচ্ছে?
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল : গত ১৬ বছর এদেশের সর্বস্তরের জনগণ গণতন্ত্রের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতা তাদের প্রাণের বিনিময়ে এবং হাজার হাজার মানুষের অঙ্গহানির বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালাতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের এই ত্যাগের একটাই কারণ ছিল- তারা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চায়। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। সংবিধানেও আছে, জনগণ সব ক্ষমতার মালিক। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তার এই ক্ষমতার প্রতিফলন ঘটায়। বিএনপি সব সময় বলে আসছে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে। আমরা মনে করছি, যৌক্তিক সময় শেষের পথে। এ কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিবের অসন্তুষ্ট হওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি, মতবিনিময় করা হচ্ছে। নির্বাচনে কে ক্ষমতায় যাবে তা বিএনপির বিবেচ্য বিষয় নয়। যেই দলই ক্ষমতায় আসুক আমরা তাদের স্বাগতম জানাব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলাগুলো কোন পর্যায়ে?
কায়সার কামাল : বেগম খালেদা জিয়ার নামে এখন আর কোনো মামলা নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলাই প্রায় খারিজ হয়ে গেছে, বাকিগুলো বাতিল হয়েছে। একটি মামলা আছে যা ওয়ান ইলেভেনের সময় দায়ের করা হয়। তথাকথিত দুর্নীতি দমন কমিশনের সময়ে। ওই মামলাটা নিম্ন আদালতে পেন্ডিং আছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই মামলাটির কারণেই তারেক রহমান দেশে ফিরছেন না?
কায়সার কামাল : তারেক রহমানের দেশে ফেরার সঙ্গে মামলার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ উনি আইনের শাসনে বিশ্বাসী। আইন আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রচলিত সিআরপিসির প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মামলার বিষয়ে যখন যা আসে তিনি তখন সেটাকে সেভাবে মোকাবিলা করবেন। দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা অনেক আগ্রহ নিয়ে তার অপেক্ষা করছেন। যথা সময়েই তিনি দেশে ফিরে আসবেন- ইনশা আল্লাহ।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ৬০ লাখ মামলা কোন পর্যায়ে?
কায়সার কামাল : দুঃখজনক। এসব মামলা প্রত্যাহারের গতি নেই বললেই চলে। মানুষ এবং রাজনৈতিক কর্মীরা এটিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। দিনে দিনে তারা ফুঁসে উঠছেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে বিএনপির অবস্থান কী হবে?
কায়সার কামাল : বিশ্বাস করি ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্যই তার অঙ্গীকার রক্ষা করবেন এবং নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন দেবেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কটা এখন কেমন? কায়সার কামাল : আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো সংগঠনের সঙ্গেই বিএনপির দূরত্ব নেই। তারেক রহমান অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক দল যুদ্ধ করেছে সবদল নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ হবে। এটি থেকেই প্রমাণ হয় যে, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যবসা-বাণিজ্য কমছে। নতুন করে বিনিয়োগ আসছে না। করণীয় কী?
কায়সার কামাল : দেশে যখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং স্থিতিশীলতা থাকে তখন বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ে। মানুষের একটা আস্থার জায়গা সৃষ্টি হয়। জবাবদিহিতা তৈরি হয়। বর্তমান সরকার জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নন। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। জবাবদিহিতার জায়গাটা তাদের নেই। এজন্যই বিনিয়োগ যেভাবে আশা করা হয়েছিল সেভাবে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের আট মাসের সফলতা-ব্যর্থতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কায়সার কামাল : মানুষ মূল্যায়ন করবে যথাসময়ে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের কাছে বিএনপির প্রত্যাশা কী?
কায়সার কামাল : ২০০৮ সালে মানুষ কম-বেশি ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল। তারপর কোনো নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যায়নি। মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। বিএনপি জনগণের দল জনগণের প্রতিধ্বনি নিয়েই কথা বলবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ৫৪ বছরেও স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলো না। এর পেছনে অন্তরায় কী?
কায়সার কামাল : এজন্য কাউকে এককভাবে দোষারোপ করা যাবে না। যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকত তাহলে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চল্লিশ বছরের ভিটা থেকে এক কাপড়ে বের হতে হতো না। আর খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে এক কাপড়ে বের করা হয়েছিল বলেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। বিচার বিভাগ অনেকাংশেই এগুলোর জন্য দায়ী। বিচারের নামে অবিচার হয়েছে। বিচারের নামে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ শত সহস্র মানুষকে নির্জন কারাগারে বসবাস করতে হয়েছে। সলিটারি কনফাইনমেন্টে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এর জন্যও দায়ী বিচার বিভাগ। আমরা সব সময় বলে এসেছি, বিচার বিভাগ স্বাধীন হোক। বর্তমানে বিচার বিভাগের যে সংস্কার চলছে সেখানে আমরা বলেছি, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ স্বাধীন করা হোক।