ভারত আপাতত কূটনৈতিক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ শুরু করেছেন। ভারতের পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যারা রয়েছেন তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। ঝিলাম নদীর পানিবণ্টন বা সিন্ধু নদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
গতকাল ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি জানান, কাশ্মীর হামলার পর ভারতের পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মী ৫০ থেকে কমিয়ে ৩০ করা হবে। ঝিলাম নদীর পানিবণ্টন বা সিন্ধু নদের চুক্তি আপাতত বাতিল, যতক্ষণ পাকিস্তান জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিচ্ছে। তিনি আরও জানান, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের বাঘা সীমান্ত বন্ধ থাকবে। যারা ভিসা নিয়ে এসেছেন, তাদেরও ফিরে যেতে হবে। এ ছাড়া পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যারা রয়েছেন তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতও পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে তাদের প্রত্যাহার করছে।
কাশ্মীরে হামলায় কারা : ভারত-শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটন কেন্দ্র পহেলগাঁওয়ে মঙ্গলবার বিকালে ভয়াবহ হামলার প্রতিবাদে গতকাল সেখানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়েছে। খবরে বলা হয়, গত ৩৫ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো কাশ্মীর উপত্যকায় এরকম সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সমাজের সব স্তরের সংগঠন এ হরতালে সমর্থন দেয়। এদিকে সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৮ জন। ভারত-পাকিস্তান ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় অবস্থা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সর্বস্তরেই প্রশ্ন উঠেছে, কারা ছিল এই ভয়াবহ হামলার নেপথ্যে? ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, হামলার দিন জলপাই রঙের পোশাক পরে ঘোড়ায় চেপে ছয়-সাতজন জঙ্গি পহেলগাঁও রিসোর্টে প্রবেশ করে। এরপর তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আচমকা ৪০ থেকে ৫০ রাউন্ড গুলি চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করে জঙ্গিরা ‘টার্গেট কিলিং’ চালায়। নিহতরা সবাই দেশ-বিদেশের পর্যটক, যাদের মধ্যে নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে। অনেকেই জানান, জঙ্গিরা তাদের ধর্মপরিচয় জানতে চায়। এর পর লাইন করে দাঁড় করিয়ে পুরুষদের ওপর মেশিনগান চালায়। খবরে বলা হয়, এরই মধ্যে এ হামলার দায় স্বীকার করেছে টিআরএফ বা দ্য রেজিস্ট্যান্ট ফ্রন্ট নামে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মদদপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, হামলাকারীদের পরিচয় বের করতে গোয়েন্দারা সন্দেহভাজন জঙ্গিদের ছবি ও স্কেচ প্রকাশ করেছে। হামলায় অংশ নেওয়াদের মধ্যে তিনজনের ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। এই তিনজন হলেন- আসিফ ফৌজি, সুলেমান শাহ ও আবু তালহা। তাদের কোডনেম মুসা, ইউনূস এবং আসিফ। এর বাইরে জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড আদিল গুরু পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, পহেলগাঁওয়ে যারা জঙ্গিদের হামলার শিকার হন, তারা যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী আঁকা হয়েছে স্কেচ। ছবি প্রকাশ করা হয় এর পরে। নিরাপত্তাবাহিনীর সন্দেহ, জঙ্গিরা পাকিস্তানের কিশতওয়ার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে কাশ্মীরে ঢুকে থাকবে। জঙ্গিদের ধরতে এখন চিরুনিতল্লাশি চলছে উপত্যকায়। এ হামলার ঘটনায় এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ও ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। যার একটি ছবিতে একে-৪৭ রাইফেল হাতে নিয়ে একজন জঙ্গি হেঁটে বেড়াচ্ছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ‘লস্কর-ই-তইবা’র ছত্রছায়ায় থাকা সংগঠন টিআরএফ হামলা চালানোর আগে এ এলাকায় সাত দিন ধরে র্যাকি করে। এপ্রিলে পর্যটনের ভরা মৌসুমে যখন ডাল লেক, গুলমার্গ, সোনমার্গ, পহেলগাঁওয়ে পর্যটকের ঢল নেমেছে, তখনই এই ‘রিসোর্ট জেহাদ’-এর ছক কষা হয়। মূলত ‘লস্কর-ই-তইবা’ ‘তেহরিক-ই-মিলাত ইসলামিয়া’ এবং ‘ঘাজনাভি হিন্দ’-এর মতো জেহাদি সংগঠনের কার্যকলাপ বাস্তবায়নে টিআরএফ একটি ছায়া সংগঠনের ভূমিকা নিয়েছে। এ সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছে সাজিদ জাট, সাজ্জাদ গুল ও সালিম রেহমানি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এ সংগঠন নিজেদের প্রচার ও নেটওয়ার্ক গড়েছে।
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল গোটা জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে দোকান, পেট্রোল পাম্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা থাকে। গণপরিবহন কম দেখা গেলেও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করেছে। বেসরকারি স্কুল, কলেজগুলো বন্ধ থাকলেও সরকারি স্কুল খোলা ছিল। এদিন সব পরীক্ষা স্থগিত রেখে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপত্যকার অন্য জেলাগুলোতেও সর্বাত্মক হরতালের চেহারা নিয়েছিল। দক্ষিণ ও উত্তর কাশ্মীরে একই রকম দৃশ্য দেখা গেছে। বারামুল্লায়, শিক্ষার্থী সংগঠন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা শোক ও সংহতি প্রকাশ করে প্রতিবাদী মিছিলে সংগঠিত করেছে। গান্ডারবাল এবং অনন্তনাগে দোকানদাররা স্বেচ্ছায় তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। নজিরবিহীন এ হরতাল সব রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় নেতা এবং নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করেছে এবং সবাই এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। ওই ঘটনার পর মঙ্গলবার শ্রীনগর থেকে অনন্তনাগ, শোপিয়ান থেকে বারামুল্লা শান্তি ও ন্যায়বিচারের স্লোগানে গোটা উপত্যকা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। দিনভর প্রতিবাদ সমাবেশ, মোমবাতি প্রজ্বলন এবং নীরব মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রীনগরে, জম্মু কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি মেহবুবা মুফতি শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্ব দেন। হুরিয়ত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান এবং কাশ্মীরের প্রধান ধর্মীয় নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুকও তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, যে একজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করে... সে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করেছে।’
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া : আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পহেলগাঁওয়ে হামলার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এনিয়ে যেকোনো সন্দেহ খারিজ করে শোক জানিয়েছে পাকিস্তান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিশ্বনেতারা এ হামলার নিন্দা করে ভারতের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। পাকিস্তানের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ভারতের অবৈধভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় হামলায় পর্যটকদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।’ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো সবই তাদের (ভারত) দেশীয় বিদ্রোহ। তাদের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে। একটা নয়, দুটো নয় কয়েক ডজন রাজ্যে-নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীর, দক্ষিণে, ছত্তিশগড়ে, মণিপুরে।’ তবে তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান সব সময় যে কোনো ধরনের সন্ত্রান্সের বিরুদ্ধে।’
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও সংসদ সদস্য শেরি রহমান এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘পহেলগাঁওয়ের মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করছি। দুর্ভাগ্যবশত, এ হামলার জন্য আগেভাগে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা, ভারতের দিক থেকে একটা সাধারণ বিষয়।’