নেত্রকোনার একই উপজেলা থেকে তিন তরুণ এসেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। তিনজনই জানালেন, তারা ভাতা পাচ্ছেন না। তাদের গেজেট নম্বর দেখে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, জেলা কমিটি থেকে তিনজনের গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে তাদের ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছে।
মক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ও অসংগতির পরিপ্রেক্ষিতে সব মিলিয়ে এমন আরো অনেকের গেজেট বাতিল হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ১২৭ জনের একটি তালিকাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের গেজেট বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
এ বিষয়ে কিছু দিন আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, আগের তালিকাগুলো (গেজেট) যাচাই-বাছাই হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছে এবং পত্র-পত্রিকাতেও এসেছে যে আগের তালিকাভুক্তদের কেউ কেউ জুলাই আন্দোলনে আহত হননি বা আন্দোলনে ছিলেন না। সেগুলো নিয়ে সরকার চিন্তিত।
এর আগে গত ৩ আগস্ট শহীদদের তালিকা থেকে আটজনের নাম বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। বর্তমানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৬ জন। তবে এবারই প্রথম জুলাই যোদ্ধার গেজেট বাতিল করার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। সরকারি তালিকায় ‘অতি গুরুতর আহত’ (ক), ‘গুরুতর আহত’ (খ) ও ‘আহত’ (গ)- এই তিন শ্রেণিতে এখন পর্যন্ত মোট আহত বা জুলাই যোদ্ধা ১৩ হাজার ৮০০ জন। আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন ১০৪ জন, একাধিকবার নাম এসেছে ২৩ জনের
সুপারিশকৃত ১২৭ জনের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর মধ্যে ১০৪ জনই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। প্রকৃত আহত নন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের কোনো তথ্য দেখাতে না পারা, আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে আহত না হওয়া- এসব কারণে ১০৪ জনের গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
১২৭ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৯ জনের নাম বাতিলের সুপারিশ রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে। এই বিভাগে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন- এমন সংখ্যা ৩৫। চারজনের নাম তালিকায় একাধিকবার এসেছে। সবচেয়ে কম জুলাই যোদ্ধাদের গেজেট বাতিলের সুপারিশ এসেছে বরিশাল ও রংপুর বিভাগ থেকে। বরিশালের দুজনের নাম একাধিকবার এসেছে তালিকায়। রংপুর বিভাগে গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা দুজন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বা আন্দোলনে আহত হননি।
সিলেট থেকে ২৭ জন, ময়মনসিংহ থেকে ২১ জন, ঢাকা থেকে ১৪ জন, রাজশাহী থেকে ১৩ জন, খুলনা থেকে ৯ জনের গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে সিংহ ভাগই ‘গ’ শ্রেণির জুলাই যোদ্ধার তালিকায় রয়েছেন। ‘ক’ ও ‘খ’ শ্রেণি থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে এমন সংখ্যা খুব কম।
যেভাবে যাচাই-বাছাই : চলতি বছর জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে যে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত না থেকেও কেউ কেউ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এমন বাস্তবতায় জুলাই শহীদদের পাশাপাশি জুলাই যোদ্ধাদের গেজেট যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এ প্রসঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, আমরা যাদের (শহীদ) গেজেট বাতিল করেছি, তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল। আমরা সব জেলাতেই জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের তথ্য চেয়েছি। জেলা কমিটিগুলোকে অবহিত করেছি। সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছি। যাঁদের বিষয়ে গণমাধ্যমে তথ্য এসেছে, তাদের ব্যাপারেও যাচাই-বাছাই হচ্ছে।
গত ১৭ জুন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তরকে এই অধ্যাদেশের অধীনে বহাল করে। গত ২০ আগস্ট অধ্যাদেশে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন বিধিমালা, ২০২৫’ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সেখানে বলা হয়- জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত জেলা কমিটি’ থাকবে।
জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (সব), সভাপতি কর্তৃক মনোনীত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের একজন প্রতিনিধি ও সভাপতি কর্তৃক মনোনীত জুলাই যোদ্ধাদের একজন প্রতিনিধিসহ অনেকে। সদস্যসচিব হিসেবে থাকবেন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক।
মূলত এ কমিটিগুলোই বিভিন্ন জেলায় নতুন আবেদন নেওয়া ও আগের গেজেট যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর বরাবর সুপারিশ পাঠায়। সেই সঙ্গে গেজেট বাতিলের কিছু সুপারিশ এসেছে জুলাই ফাউন্ডেশনের করা অভিযোগ থেকেও। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সুপারিশগুলো মন্ত্রণালয় আবার নিজেদের মতো করে যাচাই-বাছাই করেছে।
মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ে অসংগতির বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান বলেন, চিকিৎসার যথাযথ কাগজ না থাকা, অনেকে আন্দোলনে না থেকেও কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন-আমরা এ রকম নানা অসংগতি তুলে ধরেছি প্রতিবেদনে।
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ