১৯৫১ সালে গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মসলিন কটন মিলস। ৮১.১৪ একর বা ২৪৩.৪২ বিঘা জমির ওপর গড়া মিলটি অর্থাভাবে ১৯৯৪ সালে বন্ধ হয়ে গেলে রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৌশলে মিলটি কিনে নেন হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আওয়ামী লীগ নেতা এ কে আজাদ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। জানা যায়, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কাজে লাগিয়েই চার হাজার কোটি টাকা বাজারমূল্যের মিলটি রিফাত গার্মেন্টসের নামে পানির দরে মাত্র ১৩৫ কোটি টাকায় কিনে নেন এ কে আজাদ।
২০১৩ সালে মিল দখলে নেওয়ার সময় এ কে আজাদ শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের আশ্বাস দিলেও কথা রাখেননি। প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাওনার জন্য আড়াই হাজার শ্রমিক-কর্মচারী এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন। ধার্য দর ১৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ২৫ কোটি টাকা নগদে পরিশোধ করেন এ কে আজাদ। শর্ত ছিল, বাকি টাকা প্রতিবছর ২২ কোটি করে পাঁচ বছরে ২০১৮ সালের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে; না করলে বাতিল হবে চুক্তি। কিন্তু তা লঙ্ঘন করা হয়েছে সরাসরি। এই বকেয়া পরিশোধ করেন ২০২৪ সালের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। মিলের সাবেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে মিল কেনার পুরো টাকা পরিশোধের শর্ত ভঙ্গ করায় চুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল হয়ে গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, এই দখলে তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে হাত করা হয়। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট মিলের ভেতরে হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি। ৩১৮ জন শ্রমিককে শুধু গ্র্যাচুইটির টাকার চেক তুলে দিয়ে মিল বুঝিয়ে দেওয়া হয় হা-মীম গ্রুপের মালিককে। কথা ছিল, পরদিন অন্যদের মজুরি ও ভাতা পরিশোধ করবেন ক্রেতা এ কে আজাদ। কিন্তু সেই পরদিন আর আসেনি।
মিলের রিং বিভাগের সাবেক শ্রমিক আবুল কালাম পাটোয়ারী বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল, মিল বুঝে নেওয়ার আগেই দুই হাজার ৪০০ শ্রমিক-কর্মচারীর পাওনা ২০০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হবে। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও আর কোনো টাকা পরিশোধ করেনি হা-মীম গ্রুপ। মিলের সাবেক সুপারভাইজার শ্রমিক নেতা মো. ইউসুফ আলী প্রশ্ন করেন, যেখানে শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা ছিল ২০০ কোটি টাকার বেশি, সেখানে মিল কিভাবে ১৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি হয়? তিনি আরো বলেন, চুক্তির শর্তেই ছিল শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটিসহ অন্য সব পাওনা কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে।
ইউসুফ আলী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই মসলিন কটন মিলে তুলা থেকে সুতা ও কাপড় উৎপাদন এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডায়িংয়ের ব্যবস্থা ছিল। ছিল ৫২ হাজার টাকু, ৪৯৮টি উইভিং ও ৪৯৬টি স্পিনিং লুম বা তাঁত। তিন শিফটে কাজ করতেন আড়াই হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ইউসুফ আলী মনে করেন, মিল বিক্রিতে পুকুর নয়, সাগরচুরির মতো দুর্নীতি হয়েছে। তিনি বলেন, যেখানে মিলের ২৪৩.৪২ বিঘা জমির দাম তখনই ৫০০ কোটি টাকার বেশি ছিল, সেখানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি) স্থাপনাসহ বিশাল মিলটি বিক্রি করে মাত্র ১৩৫ কোটি টাকায়। এ ছাড়া মিলের বাইরে আরো ২৬ একর (৭৮ বিঘা) জমি ছিল। ওইসব জমিও দখল করে নেয় এ কে আজাদের হা-মীম গ্রুপ। তাঁর হিসাবে ২০১৩ সালে বিক্রির সময় জমি, মেশিনপত্র, স্থাপনা মিলিয়ে মিলটির মূল্য ছিল কমপক্ষে চার হাজার কোটি টাকা। ওই শ্রমিক নেতা বলেন, বিক্রির আগে মূল্য নিরূপণ, দায়-দেনা নির্ধারণ, মন্ত্রিসভা ও সরকারের শিল্প-কারখানা বেসরকারীকরণ কমিটির সভায় অনুমোদন এবং উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রির বিধান থাকলেও সেসবের কিছুই মানা হয়নি।
ইউসুফ আলী আরও বলেন, মিল দখলে নেওয়ার পর এ কে আজাদ পুরনো লোহালক্কড় বিক্রি করেন ২০ কোটি টাকায়। এ ছাড়া ডায়িং মেশিন, বৈদ্যুতিক মোটর এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিক্রি করে এ কে আজাদ আরো অন্তত ৩০ কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন বলে শোনা যায়।
মসলিন কটন মিলের একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৮২ সালে সরকারি মিলটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে নতুন মালিক ভূঁইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানা ছিল ৫১ শতাংশ এবং সরকারের মালিকানা ছিল ৪৯ শতাংশ। ১৯৯৩ সালে কর্মচারী-শ্রমিকদের ঈদের ছুটি দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে কাঁচামালের অভাব দেখিয়ে ছুটি বাড়াতে থাকে। এতে মালিক বা সরকারপক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের কোনো নোটিশ দেয়নি। মিল বন্ধের সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের সার্ভিস বেনিফিট, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ চালু অবস্থায় সাত মাসের বেতন বকেয়া ছিল। লে-অফ না করায় তাঁদের চাকরি শ্রম আইন অনুসারে এখনো বহাল আছে।
সাবেক এই কর্মকর্তা আরো বলেন, বর্তমান রিফাত গার্মেন্টসের অবৈধ চুক্তির মেয়াদ বাতিল হয়েছে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। রাজস্ব ও কর ফাঁকি দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান মালিক দখল করেছেন শীতলক্ষ্যা নদীর জমি। তরল বর্জ্য নদীতে ফেলে মারাত্মক দূষণ করছেন।
এদিকে বকেয়া পাওনার জন্য ঘুরতে ঘুরতে কেউ মারা গেছেন, কেউ অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তাই বাবার বকেয়া পাওনা টাকা আদায়ে ২০২৪ সালের ১৯ অক্টোবর কারখানার প্রধান ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে মসলিন কটন মিল শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ব্যানারে মিলের সাবেক শ্রমিক-কর্মচারীদের সন্তানরা।
সংগ্রাম পরিষদের অর্থ সম্পাদক, উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী ফারিয়া আলম জেনি জানায়, তার দাদা সিরাজউদ্দিন এই মিলের শ্রমিক ছিলেন। প্রায় ২০ বছর আগে দাদা মারা গেলে তার বাবা রফিকুল আলম রতনের নেতৃত্বে দুই হাজার ৪০০ শ্রমিকের পাওনা আদায়ে গঠন করা হয় মসলিন কটন মিল শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ। কমিটির সভাপতি করা হয় তার বাবাকে। তিনি ২০ বছরে বহু চেষ্টা করেও পাওনা আদায়ের সংগ্রাম চলাকালেই ২০২৪ সালের ৮ জানুয়ারি মারা যান। দাদার বকেয়া টাকার জন্য ঘুরতে ঘুরতে তার বাবা মারা গেছেন। এখন জেনি আন্দোলনে শরিক হয়েছে।
সাবেক শ্রমিক-কর্মচারীরা বলেন, হস্তান্তরের দিন শুধু ৩১৮ জন শ্রমিকের বকেয়া সাত মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়। পাওনা আদায়ে তৎকালীন বস্ত্রমন্ত্রী, সচিব ও রিফাত গার্মেন্টসসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা করা হয়। কিন্তু রিফাত গার্মেন্টস টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করছে।
এ কে আজাদ স্বৈরাচার হাসিনার দোসর ছিলেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি ফরিদপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে মিল ক্রয়ের সময় এ কে আজাদ ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এবং শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওই প্রভাবে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পৌরকর ফাঁকি দিত রিফাত গার্মেন্টস। হাসিনার পতনের পর নতুন করে পৌরকর নির্ধারণ হলে আগের মতো কম কর নেওয়ার জন্য আপিল করেন একে আজাদ। কর হ্রাসের জন্য চলে চাপ প্রয়োগ। কাজ না হওয়ায় তৎকালীন ইউএনওকে কালীগঞ্জ থেকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বদলি করিয়ে দেওয়া হয় প্রভাব খাটিয়ে।
তবে এসব বিষয়ে কথা বলতে হা-মীম গ্রুপের কেউ রাজি হননি।
সৌজন্যে - কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ