ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছরের ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই এবং ৪ ও ৫ আগস্ট গুলিতে আহত বেশিসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গুলিবিদ্ধ বেশির ভাগ রোগীর গুলির ডিরেকশন ছিল ওপর থেকে নিচের দিকে। সাধারণত গুলির ডিরেকশন থাকে নিচ থেকে ওপরের দিকে বা সমান্তরালভাবে। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে মাথায় গুলি লেগে তা পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য তুলে ধরেন ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন মোস্তাক আহমেদ। তিনি বলেন, রোগীরা জানিয়েছেন তাদের কোনো উঁচু জায়গা অথবা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ২৭তম সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ তিনি জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে এই চিকিৎসক বলেন, ঢাকা মেডিকেলের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কিছু নেতা বলেছিলেন, ‘এরা (আন্দোলনকারী) সন্ত্রাসী, এদের চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।’ চিকিৎসা প্রদানে উৎসাহ দেখানোয় পাঁচ চিকিৎসককে বদলিও করা হয়।
গতকাল আরও জবানবন্দি দেন প্রসিকিউশনের ২৫তম সাক্ষী হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহকারী পরিচালক ডা. মফিজুর রহমান, ২৬তম সাক্ষী ঢাকা মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের সহকারী সার্জন মনিরুল ইসলাম, ২৮তম সাক্ষী ফেনীতে পুলিশের গুলিতে আহত নাসির উদ্দিন এবং ২৯তম সাক্ষী চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত শাহারিয়ার খান আনাসের নানা সাইদুর রহমান খান। এ দিনে প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ২৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গুলির ডিরেকশন ওপর থেকে নিচে : ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মোস্তাক আহমেদ জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ১৯, ২০, ২১ জুলাই এবং ৪ ও ৫ আগস্ট বেশিসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করি। বেশির ভাগ আগত গুলিবিদ্ধ রোগীর গুলির ডিরেকশন ছিল ওপর থেকে নিচের দিকে। ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চাকরি করার সুবাদে আমি আগেও গুলিবিদ্ধ রোগীদের চিকিৎসা করেছি। সাধারণত গুলির ডিরেকশন থাকে নিচ থেকে ওপরের দিকে বা সমান্তরালভাবে। সে সময় রোগীরা জানিয়েছেন তাদের উঁচু জায়গা থেকে বা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে মাথায় গুলি লেগে তা পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়।’
আমার বড় পরিচয় আমি শহীদ আনাসের নানা : চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত শাহারিয়ার খান আনাসের নানা সাইদুর রহমান খান তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘এখন আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি শহীদ শাহারিয়ার খান আনাসের নানা।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে আমরা ঘুম থেকে উঠে আনাসকে বাড়িতে পাইনি। খোঁজাখুঁজি করে তার পড়ার টেবিলে তার মায়ের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি পাই। ওই চিঠি থেকেই জানতে পারি আনাস আন্দোলনে গিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আনাসের সঙ্গে একটি সিমবিহীন বাটন ফোন ছিল, ওই মোবাইল ফোনে আমাদের পরিবারের ৪-৫টি নম্বর সেভ করা ছিল। দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ফোন কল আসে আনাসের মায়ের মোবাইলে। জানতে চাওয়া হয় আমাদের পরিবার থেকে কেউ আন্দোলনে গিয়েছে কি না। তখন আনাসের মা বলে আমার ছেলে আনাস আন্দোলনে গিয়েছে। তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় আপনারা স্যার সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড মেডিকেল হাসপাতালে আসেন। পরে আমরা তিনজন (আনাসের বাবা-মাসহ) মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। ওখানে গিয়ে স্ট্রেচারের ওপর আনাসকে রক্তাক্ত অবস্থায় শায়িত অবস্থায় দেখি। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার আনাসকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল থেকে আমাদের বলা হয় দ্রুত লাশ নিয়ে যেতে। তারপর আমরা রিকশায় করে আনাসের লাশ বাসায় নিয়ে আসি। জানাজা শেষে ওই দিনই জুরাইন কবরস্থানে আনাসকে দাফন করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি পরবর্তীতে জানতে পারি চানখাঁরপুলের কাছে নবাব কাটারা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় আনাস। আমি আরও জানতে পারি ওইদিনই আনাসহ ছয়জন সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়। তৎকালীন সরকারের পুলিশ বাহিনী গুলি করে।’ এ ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ যারা গুলি করেছে তাদের দায়ী করে ফাঁসি চান এই সাক্ষী।