প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শনিবার বিশ্ব হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিবস পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘Achieving the Promise: Universal Access to Palliative Care’ বা প্রতিশ্রুতি পূরণ : প্যালিয়েটিভ কেয়ারে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার। এই প্রতিপাদ্যটি ২০২৪ সালে প্রচারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। গত বছর প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতির ১০ বছরপূর্তি উদ্যাপন করেছে। এ উপলক্ষে পৃথিবীর সব দেশকে ‘জীবনের পুরোটা সময় ব্যাপক যত্নের একটি উপাদান হিসেবে এই সেবাকে শক্তিশালী করার’ আহ্বান জানান হয়েছিল। এবারের প্রতিপাদ্য হলো সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করার অঙ্গীকার।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর হসপিস অ্যান্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার (আইএএইচপিসি) পরিচালিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু মিলিয়ে ৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন হয়। যার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে। এ দেশগুলোতে এই সেবার প্রয়োজন হয় প্রায় ৭৩ মিলিয়ন লোকের। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পূরণ করা হলেও, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বৃহত্তর চাহিদার মাত্র ৪ শতাংশ পূরণ করা হচ্ছে, যা এক চলমান ও হতবাক করা বৈষম্য।
প্রাপ্তবয়স্ক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা ৫০ বছরের বেশি বয়সি, তাদের হার ৬৮.১ শতাংশ। আর কমপক্ষে ৭.৫ শতাংশ শিশুর এই সেবার প্রয়োজন হয়। পরিসংখ্যান আরও বলছে, প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন হয়- এমন রোগে আক্রান্ত রোগী হচ্ছে : কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগজনিত (৩৮.৫%), ক্যানসার (৩৪%), দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ (১০.৩%) এইডস (৫.৭%), ডায়াবেটিস (৪.৬%)। এর বাইরে আর যেসব রোগের জন্য প্যালিয়েটিভ সেবার প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে, কিডনি অকেজো, দীর্ঘস্থায়ী লিভার সিরোসিস বা ক্যানসার, মাল্টিপল সেক্লরোসিস বা ধমনিজাতীয় রোগ, পারকিনসন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, স্নায়বিক রোগ, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রষ্টতা, জন্মগত অসংগতি, ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে এই সেবা প্রাপ্তির হার আরও করুণ। জাতীয় জনসংখ্যা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি বছর দেশে নানা কারণে প্রায় ৭ লাখ মানুষের প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার শিশুও রয়েছে। বিশাল এই সংখ্যার মধ্যে মাত্র ১ শতাংশকে সেবা দেওয়া সম্ভব হয়। বেশির ভাগ রোগী পর্যাপ্ত পরিচর্যা ছাড়াই চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে চলে যায়। ডিমেনশিয়া, ক্যানসার, শেষ পর্যায়ের কিডনি অকার্যকর এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা বৃদ্ধি দেশে এই সেবার অপরিহার্যতা তুলে ধরে। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বয়সজনিত কারণেও এ সেবার প্রয়োজন দিনদিন বাড়ছে। তবে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনো প্রস্তুত নয়। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, চারপাশের পাঁচটি পরিবারের মধ্যে অন্তত একটি পরিবারে এক বা একাধিক এই রোগী আছে।
নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে একজন মানুষ যখন আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষা করে তখন তাকে যে সেবা দেওয়া হয়, তাকেই বলে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা উপশম সেবা। প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা উপশম সেবার সংজ্ঞায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা উপশমকারী যত্ন হলো এমন একটি পদ্ধতি যা রোগী (প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু) এবং তাদের পরিবার, যারা জীবন-হুমকির অসুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। এটি শারীরিক, মনোসামাজিক বা আধ্যাত্মিক হোক না কেন, ব্যথা এবং অন্য সমস্যাগুলোর প্রাথমিক শনাক্তকরণ, সঠিক মূল্যায়ন এবং চিকিৎসার মাধ্যমে কষ্ট প্রতিরোধ করে এবং উপশম করে।’ অর্থাৎ গতানুগতিক চিকিৎসা সেখানেই সম্ভব, যেখানে রোগীর নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসকের সক্রিয় সহযোগিতা যখন নিরর্থক হয়ে পড়ে! তখনই প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কাজ শুরু হয়! স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন-সীমিতকারী রোগে আক্রান্ত কোনো অসুস্থ ব্যক্তির জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের সমস্যা এবং সম্ভাবনাগুলো যখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্যালিয়েটিভ কেয়ারে প্রবেশাধিকারের উন্নতি করতে পারলে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদেরও জীবনের মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করা সম্ভব। অনেকের জন্য, গুরুতর অসুস্থতার সময় চিকিৎসার পরিবর্তে জীবনমানের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন হয়। এখানে প্যালিয়েটিভ কেয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এটি শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করে। প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিরাময় অযোগ্য অথবা জীবন-সীমিতকারী রোগে আক্রান্ত মানুষের জীবনের মান বাড়ায়, তাকে ব্যথামুক্ত করে এবং অন্যান্য শারীরিক উপসর্গ দূর করে। একই সঙ্গে মনো-সামাজিক এবং আত্মিক দিকগুলোর প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়। রোগীর প্রতি সর্বোচ্চ কার্যকরী সেবা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে, প্যালিয়েটিভ কেয়ার দেওয়া শুরু হয় ঠিক যখন থেকে রোগটি নির্ণীত হয়। চলে রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসার পাশাপাশি এবং রোগীর মৃত্যুর পর তার পরিবারকে বিয়োগান্তক সেবা প্রদান করা হয়। যেসব ক্ষেত্রে রোগটি নিরাময়যোগ্য, সেখানে প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিয়ে থাকে সাহায্যকারী সেবা, যেমন-ব্যথামুক্তি, উপসর্গের চিকিৎসা এবং কষ্ট কমানো। এই উপাদানগুলোর কতটুকু আমরা পূরণ করতে পারি? দেশে ডাক্তার এবং প্যারামেডিক্সের যে অনুপাত, তাতে অন্য রোগীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি এই বিশালসংখ্যক প্যালিয়েটিভ রোগীর সেবা দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত জনবল অপ্রতুল। বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
লেখক : গবেষক