ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই সাংগঠনিক সংকট প্রকট হচ্ছে জুলাই বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি)। আর মাত্র দেড় মাস পর ভোটযুদ্ধ মাঠে গড়াতে চললেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেনি দলটি। নির্বাচন নিয়ে দলীয় কৌশল কী হবে তা জানতে না পেরে দিনদিন হতাশা বাড়ছে নবগঠিত দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছ থেকে দলীয় নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকলেও দলীয় প্রতীক ‘শাপলা’ নিয়ে ঘনীভূত হচ্ছে নতুন সংকট। ইসির প্রতীক তালিকায় না থাকলেও শাপলা পাওয়া নিয়ে আশাবাদী দলটির নেতারা।
দলীয় সূত্র জানায়, ইসি শাপলা না দেওয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত শাপলাই চায় এনসিপি। এ বিষয়ে ন্যূনতম ছাড় দেবে না তারা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শাপলার জন্য রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাবেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নিতে ব্যস্ত। অথচ এখন পর্যন্ত কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় দলের সংসদ সদস্য প্রার্থী বাছাই করা হবে, কোন আসন থেকে কে লড়বেন কিংবা নির্বাচন ঘিরে কোন প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হবে দলীয় কার্যক্রম-তার কোনো আলোচনাই নেই এনসিপির অভ্যন্তরে। এ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ভিতরে তৈরি হচ্ছে সংশয়। বিশেষ করে তৃণমূলে যারা দলটির নেতা-কর্মী হিসেবে কাজ করছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার বিপরীতে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় এ নিয়ে হতাশায় ভুগতে শুরু করেছেন তারা। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে দলের ছোট-বড় সংকট মিলিয়ে এই হতাশা আরও বেড়ে চলেছে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, কয়েকটি ইস্যুর মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না তারা। এজন্যই অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনি কার্যক্রমের তোড়জোড় লক্ষ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। মূলত বিচার ও সংস্কার নিশ্চিত করতেই অন্তর্বর্তী সরকার ও তার উপদেষ্টাদের ‘চাপে’ রাখতে এমন অবস্থান গ্রহণ করেছেন তারা।
দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ রেখেছে এবং তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথাও ভাবছে।’
নাহিদ ইসলামের এমন বিস্ফোরক মন্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘কিছু উপদেষ্টার মাঝে আমরা এই আচরণ দেখতে পাচ্ছি যে তারা এখন কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্বটা পালন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো।’
নাহিদ-সারজিসের এমন মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিচার ও সংস্কার গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। সেটি পালনের দায়িত্ব নিয়েও তা না করে কোনো কোনো উপদেষ্টা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান। নাহিদ কিংবা সারজিস সেই বিষয়টিই বলেছেন।’
নির্বাচনি প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির নেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান বিচার, সংস্কার এবং দলীয় প্রতীক ইস্যুর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভোট প্রস্তুতিতে নামবেন না তারা। দলের যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঐতিহাসিক জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ওপর আরোপিত বিচার ও সংস্কারের দায়িত্ব এখনো পূরণ করতে পারেননি। এখন দায়সারাভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে হাঁটছেন। এনসিপিও এই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। রাজনীতিতে আমাদের মূল এজেন্ডা জুলাই গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা। যেন ভবিষ্যতে আর কেউ এমন ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশের জনগণের ওপর গণহত্যা চালাতে না পারে। তিনি আরও বলেন, ‘বিচারের পাশাপাশি আমাদের আরও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর বিলোপ ঘটানো। ঐকমত্য কমিশনে যেসব সংস্কার প্রস্তাবনা এসেছে তা কীভাবে ও কখন বাস্তবায়িত হবে সেই বিষয়টিও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়নি। এসব ইস্যুর সমাধান না করে নির্বাচন ও ক্ষমতার রাজনীতির দিকে অগ্রসর হয়ে আমরা জুলাইয়ের শহীদ, আহত ও জন আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাই না।’
দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আত্মপ্রকাশের পর থেকে বিচার, সংস্কার ও নতুন সংবিধানের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এনসিপি। এই তিনটিই আমাদের মূল রাজনৈতিক এজেন্ডা। অন্তর্বর্তী সরকারও এই তিনটি এজেন্ডা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্য নিয়েই গঠিত হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি গণ অভ্যুত্থানের এই আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়ন না করেই সরকার রাজনৈতিক চাপে পড়ে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। বিচার ও সংস্কার বাস্তবায়নের প্রশ্নে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’