সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দুই সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে নানানরকম অনিশ্চয়তা এবং ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে।’ কারা সে ষড়যন্ত্র করছে সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, একটি মহল গণতন্ত্র উত্তরণকে বিলম্বিত করতে সরব হয়েছে। তবে এ অনিশ্চয়তার মধ্যেও সবচেয়ে আশার কথা হলো- নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছে। নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওর যে সংশোধনী প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন করেছে, তা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে একটি বড় উদ্যোগ। সাধারণ ভোটাররা উৎসাহিত হয়েছে। নির্বাচনসংক্রান্ত এ সংশোধনীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীকে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন। আইনে এটি যুক্ত হলে তিন বাহিনীকে নির্বাচনি দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পুলিশের মতো ভোট কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আমি মনে করি এটি অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপের ফলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে যে সংশয় তা কিছুটা হলেও দূর হবে। নির্বাচনের আগেই অনেকে নানারকম কথাবার্তা বলে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই উত্তপ্ত করতে চাইছেন। গত মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) জাতীয় যুব দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সাবেক উপদেষ্টা এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আরেকটি ‘এক-এগারো’র শঙ্কার কথা নতুনভাবে বলেছেন। এনসিপির পক্ষ থেকে ইদানীং প্রায়ই এক-এগারোর কথা উচ্চারণ করা হয়। কেন, কোন প্রেক্ষাপটে তারা এটি বলেন সেটি আলোচনার দাবি রাখে। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা নির্বাচন চাই। নির্বাচন ও ভোটাধিকারের জন্য আমাদের লড়াই ছিল। কিন্তু আমরা এও বলেছি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যেতে হবে। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে না পারে, দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে নিজেদের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি না হয়, তাহলে আরেকটা এক-এগারো আসবে। কারণ আমরা ইতিহাসে এটাই দেখেছি।’ নাহিদ ইসলামের এ বক্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার পর কেন তিনি এমনটি বললেন? একদিকে তিনি বললেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড় দিতে হবে। এটি সঠিক। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও রাজনৈতিক সৌহার্দের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ আমাদের মুখ দেখাদেখি যেন বন্ধ না হয়। মত ও পথের পার্থক্যের পর এই সম্প্রীতি জরুরি। এই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা, সৌজন্যতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যদি সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকে, তাহলে কখনোই এক- এগারো আসবে না। তবে নাহিদ ইসলামের ওই অনুষ্ঠানের বক্তব্যই স্ববিরোধী। তিনি যেমন বলেছেন ছাড় দিতে হবে, তেমনি এর বিপরীত কথাও তিনি ওই একই অনুষ্ঠানে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত এক বছর ছাড় দিয়েছি, জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দিয়েছি। জুলাই সনদে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ১ শতাংশ ছাড়ও জুলাই সনদে দেওয়া হবে না।’ অর্থাৎ একদিকে যেন তিনি বলছেন রাজনৈতিক দলগুলোকে সবাইকে ছাড় দিতে হবে। অন্যদিকে তিনি আবার বলছেন, ছাড় দেওয়া হবে না। এরকম অনমনীয় অবস্থান কখনোই একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য ইতিবাচক নয়। এরকম পরিস্থিতিই একটি এক-এগারো আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। আমরা বিশ্বাস করি নাহিদ ইসলাম জুলাই বিপ্লবের একজন অগ্রণী সৈনিক, অন্যতম নেতা। তিনি এ রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই বর্তমানে যে অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীলতা সেখান থেকে উত্তরণের একটাই পথ, তা হলো গণতন্ত্র, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচন না হলে এক-এগারো আসবে। তাহলে কি নির্বাচন বানচাল করতে চায় কোনো কোনো মহল? নাহিদ ইসলাম এবং আরও বিভিন্ন মহল থেকে যে এক-এগারোর শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, সেই শঙ্কার বাস্তব ভিত্তি কতটুকু? এ কথা ঠিক যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি ততক্ষণ পর্যন্ত একটি শঙ্কা ছিল। কিন্তু আমি মনে করি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার পর আরেকটি এক-এগারো নিয়ে সংশয় অনেকটাই কেটে গেছে।
এক-এগারো নিয়ে শঙ্কাহীন থাকার আরও একটি কারণ আছে। ২০০৭ সালে এক-এগারো সরকারের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক শক্তি ছিল বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থনেই ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অনির্বাচিত একটি সরকার ক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু এবার সশস্ত্র বাহিনী মোটেও সে পথে যাচ্ছে না। বরং সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচন, গণতন্ত্রের পক্ষে অতন্ত্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। গত বছরের জুলাই থেকে সংবিধান, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। সেই সময় তিনি চাইলেই ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারতেন, সামরিক শাসন জারি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে না গিয়ে বরং দেশে একটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে কাজ করেছেন। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়েছিল, সেনাবাহিনী আরেকটি এক-এগারো চায়নি। এ সময় নানা প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ধৈর্য, সংযম এবং দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে তা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। সেনাবাহিনীর প্রধান বারবার দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। আমরা যদি হিসাব করে দেখি, তাহলে এ সরকারের দেড় বছর মেয়াদপূর্তি হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। সেক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর আকাঙ্ক্ষা এবং অভিপ্রায় অনুযায়ী দেড় বছরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন পেছানো এবং বিভিন্ন রকম দাবিদাওয়া এনে নির্বাচন বিলম্বিত করতে চেয়েছিল, সেখানে সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে গন্তব্যে নেওয়ার আন্তরিক অভিপ্রায় আমাদের জন্য একটি বড় ইতিবাচক দিক।
আমাদের সশস্ত্র বাহিনী গণতন্ত্র চাচ্ছে। তারা আরেকটি এক-এগারোর হিস্সা হতে চায় না। গত এক বছরে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা যদি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশকে আগলে রেখেছে। বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনীতি, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সশস্ত্র বাহিনী একমাত্র আশার আলো। ৫ আগস্টের পর একটা লম্বা সময় পর্যন্ত পুলিশ কোনো কাজ করেনি। এ সময় সশস্ত্র বাহিনী জনগণের জানমালের নিরাপত্তার হেফাজত করেছে। এ সময় বেশ কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতির কারণে কোনো কিছু সীমার বাইরে যায়নি। বরং সশস্ত্র বাহিনী সব সময় চেষ্টা করেছে ঠান্ডা মাথায় বলপ্রয়োগ না করে মানুষকে শান্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে।
এখনো পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয়। মানুষের আস্থার ভরসাস্থল হলো সশস্ত্র বাহিনী। বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র বাহিনী যেভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাতে এটুকু বলা যায় সশস্ত্র বাহিনী মাঠে আছে এজন্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত সহনশীল। মানুষ অন্তত ঘর থেকে বেরোতে পারছে, কর্মস্থলে যেতে পারছে। সাধারণ জনগণের অন্তত একটি ভরসাস্থল আছে।
৫ আগস্টের পর অর্থনীতিতে একটি বড় সংকট চলছে। যাকে-তাকে ফ্যাসিবাদের ‘দোসর’ হিসেবে ট্যাগ দিয়ে কলকারখানায় আগুন লাগানো, চাঁদাবাজি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের মতো ঘটনাগুলো শুরু হয়। এ ক্ষেত্রেও সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন। সশস্ত্র বাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতির কারণে বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী এবং মবকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী যদি না থাকত তাহলে এ ধরনের ঘটনাগুলো কী ভয়াবহ রূপ নিত তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ৫ আগস্টের পর চাইলেই সশস্ত্র বাহিনী সহজে ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারত, কিন্তু সেই ক্রান্তিকালে ক্ষমতা গ্রহণ না করে সাংবিধানিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছে। আমরা যদি আরেকটু পেছনে ফিরে দেখি তাহলে দেখব বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের পতনেও সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল। সেই ইতিহাস আমরা অনেকেই স্মরণ করি না। গত বছরের জুলাই মাসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আন্দোলনকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ না করার জন্য সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। মূলত এ সিদ্ধান্ত ছিল আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। এখান থেকেই আন্দোলন নতুন পথে মোড় নেয়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জুলাই বিপ্লবকে সফল করার ক্ষেত্রে নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। শুধু তাই নয়, ৫ আগস্টের পর কী ধরনের সরকার হবে, সেটির জন্য ক্যান্টনমেন্টে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে গিয়ে বৈঠক করা এবং নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়া করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অতুলনীয় এবং গৌরবোজ্জ্বল। সেনাপ্রধান তখন নিরলসভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সব দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
আমরা আশা করি, আরপিও সংশোধনের ফলে সশস্ত্র বাহিনীর যে ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে, এর ফলে নির্বাচন ঘিরে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বা মব সন্ত্রাস, পেশিশক্তির প্রয়োগ ইত্যাদি বন্ধ হবে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী গত এক বছরের কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা আরেকটি এক-এগারো চায় না। তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় এবং ব্যারাকে ফিরে যেতে চায়। এজন্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে বিভক্তি, হানাহানি নয়, দরকার জাতীয় ঐক্য। এ ঐক্যই গণতন্ত্রের শক্তি। এক-এগারোর আতঙ্কে না ভুগে গণতন্ত্র উত্তরণের জন্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সবাইকে সম্মিলিতভাবে। মনে রাখতে হবে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতালিপ্সা ছাড়া কখনো এক-এগারোর মতো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে না। গত এক বছরে বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনী প্রমাণ করেছে তারা আরেকটি এক-এগারো চায় না। একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায়।