উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থানে যেসব উপজেলা জেলা সদরের নিকটবর্তী সেখানে আদালত স্থাপনের বিপক্ষে দলগুলো। একইভাবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জরুরি অবস্থা জারির নতুন বিধান কী হবে তা নিয়ে নানা প্রস্তাব থাকলেও বিদ্যমান বিধান পরিবর্তনে সবাই একমত।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা নিয়ে আলোচনা হয়।
আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে কিছু বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হচ্ছে। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে অধিকাংশ দলের আপত্তি থাকায় সংশোধনী এনে ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। প্রাথমিক প্রস্তাবে সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ নিয়ে দলগুলোর আপত্তি থাকায় সংশোধিত প্রস্তাবে তা ছিল না। একইভাবে চার প্রদেশে ভাগের প্রস্তাবে দলগুলোর দ্বিমতের কারণে উপস্থাপন করা হয়নি। যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেদিকে কমিশন নজর রাখছে। সবার মতামতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই অগ্রসর হচ্ছে কমিশন। অনেক কিছু বাদ দিতে হচ্ছে। আমাদের সময়ের স্বল্পতার বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতে সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। কমিশন সূত্র জানায়, জরুরি অবস্থা জারির বিধান নিয়ে আলোচনাকালে নেতারা বলেন, এদেশে কোনো যুদ্ধাবস্থা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের কারণে জরুরি অবস্থা জারি হয়নি বরং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা গোলোযোগ পরিস্থিতিতে অতীতের মতো রাজনৈতিক বিবেচনায় জরুরি অবস্থা জারি করার বিপক্ষে অবস্থান নেন তারা। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী জরুরি অবস্থা জারির সময় কোনোভাবেই নাগরিক ও মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না, এমন প্রস্তাবে অধিকাংশই একমত প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, যুদ্ধ কিংবা বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে জরুরি অবস্থা জারি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। তবে নতুন কাঠামো কী হবে, কার্যকর কীভাবে হবে, কোন কোন মৌলিক অধিকার স্থগিত হবে সেসব বিষয় নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা; জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা করে কোন কোন উপজেলায় স্থায়ী আদালত স্থাপন করা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে যেসব উপজেলায় চৌকি আদালত পরিচালিত হয়, সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সব চৌকি আদালতকে স্থায়ী আদালতে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন, নাকি সেক্ষেত্রেও পুনর্বিবেচনা ও পুনর্বিন্যাসের সুযোগ রয়েছে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে উপজেলা সদরে স্থাপিত কোনো আদালতের জন্য একাধিক উপজেলাকে সমন্বিত করে অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করা প্রয়োজন হলে, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। উপজেলা আদালতগুলোতে সিনিয়র সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের বিচারকদের পদায়ন করতে হবে। দেওয়ানি মামলা গ্রহণে সিনিয়র সহকারী জজের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে বাস্তবানুগ করাও প্রয়োজন। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে হবে। এক্ষেত্রে জেলা সদরের অতি সন্নিকটে (১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্য) উপজেলা থাকে তবে অধস্তন আদালত স্থাপনের প্রয়োজন নেই। জনসংখ্যা ঘনত্বের ভিত্তিতে যে উপজেলার জনসংখ্যা বেশি সেখানে সমীক্ষা করে অধস্তন আদালত করা যেতে পারে।
সংলাপ শেষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা কোনো পরিস্থিতিতেই যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার বিষয়ে দলগুলো একমত। বিদ্যমান সংবিধানের ১৪১ নং অনুচ্ছেদের (ক), (খ), (গ) এর সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার ব্যাপারেও দলগুলো একমত। তিনি জানান, বিদ্যমান সংবিধানের ১৪১ নং অনুচ্ছেদে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়টি আছে, যা নিয়ে অতীতে খুব বেশি আলোচনার সুযোগ ছিল না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। পূর্ববর্তী আলোচনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশন হতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে সংশোধিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ প্রস্তাব নিয়ে পরবর্তী সভায় অধিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ভবিষ্যতের আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে বলা যাবে, এ ব্যাপারে কতটুকু একমত হওয়া গেছে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো উপজেলা পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেছে বলে জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, দল ও জোটগুলো অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের জন্য কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে কওে। যেমন, সদর উপজেলাসমূহের আদালতসমূহ জেলা জজ কোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত রেখে সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। বিদ্যমান চৌকি আদালত, দ্বীপাঞ্চল ও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত আদালতসমূহ বহাল রেখে এর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। জেলা সদরের কাছাকাছি উপজেলাসমূহে নতুন আদালত স্থাপনের প্রয়োজন নেই। অবশিষ্ট উপজেলাগুলোর জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, যাতায়াত ব্যবস্থা, দূরত্ব, অর্থনৈতিক অবস্থা, মামলার সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে পর্যায়ক্রমে স্থাপন করা। অধস্তন আদালতের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, মামলা জট কমাতে সব উপজেলায় আদালত নিতে হবে। জেলা সদরের অতি কাছে যেসব উপজেলা সদর রয়েছে সেখানে অধস্তন আদালত প্রয়োজন হবে না। একই সঙ্গে জেলা সদরে উপজেলা অধস্তন আদালতের প্রয়োজন নেই। কোন উপজেলায় অধস্তন আদালত প্রয়োজন তার সংখ্যা নিরূপণের জন্য সমীক্ষার অনুরোধ করেন তিনি। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা জারির বিধান সংশোধনে তারা নীতিগতভাবে একমত। তবে কী পরিবর্তন হবে, তা নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা আছে। আগামীতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই পরিবর্তন ও সংশোধন আগামী সংসদে আলোচনা করে করা যেতে পারে বলেও জানান তিনি।
আলোচনায় অংশ নেওয়া কয়েকটি দলের নেতা উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত স্থাপন করা হলে দুর্নীতি বাড়বে আশঙ্কা করেন। বিষয়টিতে দ্বিমত জানান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত হলে দুর্নীতি বাড়বে এটা ভুল ধারণা। বিচার প্রার্থীকে হয়রানি রোধ করতে বিচারের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। দুর্নীতির বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
আদালতে বিকেন্দ্রীকরণ প্রস্তাবের পক্ষে গণসংহতি আন্দোলন একমত উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে অনেক মামলা ও গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু জামিন থেকে শুরু করে একেবারে প্রাথমিক কাজের জন্য তাদের জেলায় যেতে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের আর্থিক চাপ থাকে। অনেক সময় মামলার জন্য জেলায় গিয়ে থাকতেও হয়। তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ হলে তা প্রতিটি উপজেলায় হওয়া দরকার। সংসদীয় আসন কিংবা অন্যকিছু বিবেচনা করায় হলে তাহলে এক অঞ্চলে সঙ্গে আরেক অঞ্চলে দ্বন্দ্ব বাড়বে। উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত হলে মামলা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা বিবেচনায় না নিয়ে এটি করা দরকার বলে জানান তিনি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বর্তমান বিধান ছিল না। পরবর্তীতে এটা যুক্ত করা হয়েছে এবং তা অপব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধাবস্থা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থার জারি বন্ধ করতে হবে। জরুরি অবস্থা জারি হলে কোনোভাবেই নাগরিক ও মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। আর সার্বিক সমীক্ষা শেষ করে প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাসান সোহরাওয়ার্দী বলেন, ১৭৫টি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার বিধান রয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল আছে, তাদের তদন্ত রিপোর্ট সাপেক্ষে পরিস্থিতি বিবেচনায় জরুরি অবস্থা জারি করা যেতে পারে।