রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান পরিবর্তন ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণে ঐকমত্যে পৌঁছেছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করার রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা থাকবে না। বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আর মামলার জট কমানোর লক্ষ্যে বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ ও প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক বেঞ্চ থাকবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেওয়া হবে। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের নবম দিনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. বদিউল আলম মজুমদার ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। কমিশন সূত্র জানায়, সংলাপে সংবিধানের ৪৯নং অনুচ্ছেদের উল্লেখিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান নিয়ে আলোচনাকালে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অতীতে এই বিধানের অপব্যবহারের তথ্য তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, চিহ্নিত ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিকেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা করা হয়েছে। তাই এই বিধান পরিবর্তন হওয়া দরকার। এ-সংক্রান্ত আবেদন নিষ্পত্তির জন্য বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। তাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেবেন। আলোচনায় মামলার জট কমাতে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে একাধিক প্রস্তাব তুলে ধরেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা।
সংলাপ শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আজকের আলোচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন-সম্পর্কিত বিধান এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিগত সময়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের ৪৯নং অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছে। যার মাধ্যমে এই ক্ষমতার যে অপব্যবহার হয়েছে তা বন্ধ হবে।
বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ-সম্পর্কিত বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে। তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে যে সার্কিট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন তার পরিবর্তে রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে। প্রধান বিচারপতি কর্তৃক প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে। অর্থাৎ হাই কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ১০০নং অনুচ্ছেদের পরিবর্তন হবে।
আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত পোষণ করেছে বলে জানান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতির একক কর্তৃত্ব থাকবে না। আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের মতো আলোচিত বিষয়টি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিগত সময় দেখেছি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যথেষ্ট অপব্যবহার হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বড় বড় অপরাধ করা আসামিদের ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞের একটা উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে এটার মাধ্যমে আলোচনায় আসছে এ ক্ষমতাটা রাষ্ট্রপতির হাতে এভাবে অবারিত থাকা উচিত কি না। সেই সেন্টিমেন্টের সঙ্গে একমত পোষণ করে, আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা প্রয়োগের একটা বিধান আনা যায় কি না এবং আইনি একটা পরামর্শ সভা বা বোর্ড রাখা যায় কি না, এ ছাড়া এর সঙ্গে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা যায় কি না, কী পদ্ধতি অনুসরণ করেই ক্ষমা প্রদর্শনীর বিষয়টি করা যায়, এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছে। বিএনপি অনেক আগের থেকে চায়, বিচার বিভাগের সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো হোক। এজন্য বিভাগীয় পর্যায়ে হাই কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করা হোক। কিন্তু এটা করবে কে, সেই প্রশ্ন। বিএনপির পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে বিভাগীয় স্থায়ী বেঞ্চ না করে, বছরে একবার বা দুইবার অস্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা যেতে পারে, এমন প্রস্তাব এসেছে বলে তিনি জানান।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা একমত হয়েছি সংবিধান অনুযায়ী, একই ধরনের কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় সুপ্রিম কোর্ট থাকবে। তবে হাই কোর্টকে ডিসেন্ট্রালাইজ করে বিভাগীয় শহরেও স্থায়ী বেঞ্চ সম্প্রসারণ করা হবে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ২০ কোটি মানুষ। এই নাগরিকদের পাশাপাশি তাদের সন্তানরা বিচারের আশায় ঢাকা আসেন। তাদের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, অপেক্ষা করার মতো সুযোগ খুব কম মানুষের আছে। এ অবস্থায় সময় ও জনদাবি অনুযায়ী এটা প্রতিষ্ঠিত যে বিচারপ্রক্রিয়াকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া উচিত। এখানে সবাই একমত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত বা অপরাধীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিশেষে একটা সীমাবদ্ধতা তৈরিতে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইনসাফ ও সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটি করা হচ্ছে, ক্ষমার ফাঁকে যেন কোনো দুর্বৃত্ত বা দাগি, কোনো খুনি বা আসামি ছাড়া পেয়ে না যায়। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারবেন, তবে সেটা ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মতির ভিত্তিতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বা কমিটি ক্ষমা করতে পারবে, তা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য একটা বডি (কমিটি) করা হয়েছে। যে বডির সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারবেন। কোন কোন ক্রাইটেরিয়ায় ক্ষমা করতে পারবেন, তার একটা বিস্তারিত তালিকা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজকে নতুন একটি কথা যুক্ত করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে, যা অন্য দলগুলোও সমর্থন করেছে। তা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি বা কমিটি যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত বা সাধারণ অপরাধ আছে, সেসব ক্ষেত্রে ক্ষমার জন্য চাইলে সুপারিশ করতে পারবেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধের কারণে যদি শাস্তি হয়, যেমন কারও বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, এই হত্যার বিচার হয়েছে ফাঁসি। এ ক্ষেত্রে কমিটি বা রাষ্ট্রপতি এককভাবে চাইলে ক্ষমা করতে পারবেন না। সেখানে আমরা বলেছি, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে অবহিত করতে হবে। কারণ একজনের বাবা খুনের অপরাধে অপরাধীকে অন্য আরেকজন ক্ষমা করতে পারেন না। তবে ভুক্তভোগীর পরিবার ও প্রতিষ্ঠিত ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের সম্মতির ভিত্তিতে ক্ষমা করা যাবে। ন্যায়বিচার ও ইনসাফভিত্তিক বিচার নিশ্চিত করার জন্য এটি একটি নতুন ডাইমেনশন।’