সবকিছু ঠিক থাকলে দুই কক্ষের সংসদের দিকে যাচ্ছে দেশ। তবে সেটা আগামী সংসদ নাকি এর পরের সংসদ থেকে হবে সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো এরই মধ্যে নীতিগতভাবে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে একমত হয়েছে। জুলাই সনদে বিষয়টি যে স্থান পাচ্ছে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ওই সনদে স্বাক্ষর করার কথা দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোর। জুলাই সনদ হবে দলগুলোর একটি অঙ্গীকার।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলো এমন একটি আইনসভা যা দুটি পৃথক কক্ষ নিয়ে গঠিত। যেখানে একটি কক্ষকে উচ্চকক্ষ অন্যটিকে নিম্নকক্ষ বলা হয়। এই ধরনের আইনসভায় আইন প্রণয়নে সমান ক্ষমতার ভারসাম্য বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নিশ্চিত করা হয়। নিম্নকক্ষের সদস্যরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। তাদের হাতেই থাকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা। তবে আইন কার্যকর করতে উচ্চকক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও উচ্চকক্ষ ১০০ সদস্যের বিষয়ে দলগুলো একমত হওয়ার কথা জানিয়েছে। তবে পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে নানা মত। চলতি সপ্তাহের আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে সব দল একটা সিদ্ধান্তে আসবে বলে জানিয়েছে কমিশন। এদিকে সংসদ সচিবালয় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ তৈরি করতে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। কিন্তু এটাও বলব নীতিগতভাবে কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু এটা অধিকাংশই স্বীকার করেছেন বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। অধিকাংশই ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মত দিয়েছেন।
কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসনে নির্বাচনের পক্ষে। অন্যদিকে এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদসহ অধিকাংশ দল সংখ্যানুপাতিকে উচ্চকক্ষের পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াত উভয়কক্ষকে সংখ্যানুপাতিক করার পক্ষে। পাশাপাশি উচ্চকক্ষের নাম নিয়েও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত হলেও পিআর (প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিএনপি একমত পোষণ করেনি। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিষয়ে বোধ হয় এখন আমাদের বিবেচনা করা ঠিক হবে না। আমাদের দলের পক্ষ থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণা এজন্য দিয়েছিলাম যে, দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন সেক্টরে যাদের অবদান আছে, যাদের চিন্তাধারা, অবদান জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তাদের প্রতিনিধিত্ব আকারে এখানে যুক্ত করার জন্যই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বিবেচনা করেছিলাম।
প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, লেবার পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফ্রন্টসহ অধিকাংশ দল। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, সংসদের উভয় কক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন চান তারা। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, তারা ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে নির্বাচনের পক্ষে। ভোটের আগে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসানত আবদুল্লাহ বলেছেন, উচ্চকক্ষের আসন ভোটের অনুপাতে বণ্টন হতেই হবে। এটিই মৌলিক সংস্কার। অন্য দলগুলোর নেতারা বলছেন, ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনে প্রায় সব দলই নীতিগতভাবে একমত।
এদিকে সংসদ সচিবালয় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছে, দ্বিকক্ষ সংসদের জন্য নতুন অবকাঠামোগত বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করেছে। সংসদ ভবনের ক্যাবিনেট কক্ষকে নতুন করে সাজিয়ে সংসদের উচ্চ কক্ষ বানানোর প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অথবা শপথ কক্ষকেও উচ্চকক্ষ হিসেবে তৈরি করতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে যে অধিবেশন কক্ষ আছে সেটাকে নিম্নকক্ষ হিসেবে রাখা হবে। সুপারিশ অনুযায়ী নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা হবে ৪০০ জন। বতর্মানে ওই কক্ষে ৩৫৪টি আসন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অধিবেশন কক্ষে থাকা কূটনীতিক ও বিদেশি অতিথিদের জন্য বরাদ্দ থাকা দুটি লাউঞ্জকে নিম্নকক্ষের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়েও জানানো হয়েছে। কমিশনের খসড়া প্রস্তাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষ থাকবে ৪০০টি আসন। আর উচ্চকক্ষে থাকবে ১০৫টি আসন। নিম্নকক্ষের ৪০০টি আসনে প্রচলিত ব্যবস্থায় অর্থাৎ সরাসরি জনগণের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের ১০০টি আসনে নির্বাচন হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে সারা দেশে মোট যত ভোট পাবে সেই অনুপাতে তারা উচ্চকক্ষে আসন পাবে। তবে উচ্চকক্ষে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের কথাও বলা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিটির সুপারিশে। উচ্চকক্ষের বাকি ৫টি আসন থাকবে রাষ্ট্রপতির হাতে। সমাজের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে এই পাঁচ আসনে সংসদ সদস্য মনোনয়ন দেবেন রাষ্ট্রপতি।
বাংলাদেশে বর্তমান এক কক্ষের জাতীয় সংসদে মোট আসন ৩৫০টি। যার মধ্যে ৩০০টি আসনে সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। আর ৫০টি আসন থাকে নারীদের জন্য সংরক্ষিত। সাধারণ নির্বাচনে পাওয়া আসনের অনুপাতে এসব আসন বণ্টন করা হয়।