আগামী জুলাই মাসে ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপে আলোচনার শুরুতে তিনি এ আশা প্রকাশ করেন। ওই আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়েছে। তবে সংলাপে দেশের অন্যতম দল জামায়াতে ইসলামীর কোনো প্রতিনিধি অংশ নেননি।
কমিশন সূত্র জানায়, আলোচনা শেষে রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখার বিষয়ে একমত হয়েছে। সরকারি হিসাব কমিটি, অনুমিত হিসাব কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ীসহ কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে বিরোধীদলীয় সদস্যদের নির্বাচিত করার বিষয়ে একমত হয়েছে। এই আলোচনায় সংসদে দলীয় আসনের অনুপাতের প্রস্তাব এসেছে। আলোচনায় সংরক্ষিত নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। তবে ওই আসনগুলোতে ভোটের পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকেই সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন। কেউ কেউ বিদ্যমান সংসদীয় আসনের অনুপাতে এবং কেউ কেউ দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতিক হারে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে আস্থা ভোট ও অর্থবিল ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে নিজ দলের বিপক্ষে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারবেন, এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। তবে সংসদের দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে বিএনপিসহ কয়েকটি দল একমত হলেও সিপিবি, গণফোরাম, বাসদ, জাসদ একমত হয়নি। তারা বলছে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের যৌক্তিকতা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের এই সময় বন্দর ও মানবিক করিডরের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই বলে মন্তব্য করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বাম দলগুলো। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা ইতিবাচক এগিয়েছে। সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদের বিদ্যমান বিধান পরিবর্তন করে জাতীয় সংসদের সদস্যরা কেবল অর্থবিল এবং আস্থা ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতি অনুগত থাকবেন। কিন্তু অন্য যে কোনো বিষয়ে তাঁরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে।
সংসদের চারটি স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলের মধ্য থেকে নির্বাচনের সিদ্ধান্তে ঐকমত্য হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে নির্বাচন করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। তাঁরা সংলাপে জাতীয় সংসদের নারী আসন ১০০ করার বিষয়ে একমত। তবে কী প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে, সেটি সিদ্ধান্তের বিষয়। আর প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতিগত বিষয়ে সবাই একমত। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে অনেকে একমত। আবার কারও কারও ভিন্নমত রয়েছে। আমরা বলব, সব বিষয়ে সবাই একমত হবে না। আবার এক দিনে সবকিছু হয়ে যাবে, সেটাও আশা করা ঠিক নয়। আশা করি, একটা সময় সবকিছু সমাধান হবে। ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে।’ জামায়াত ইসলামী বুধবার সংলাপে অংশগ্রহণ করবে বলে জানান তিনি।
এর আগে আলোচনার শুরুতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য যেটা আমরা বারবার বলেছি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংকল্পবদ্ধ যে আমরা জুলাই মাসের মধ্যেই জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারব। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব, যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা ও জাবেদ রাসিন, এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ও সাজেদুল হক রুবেল, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাসদের (মার্কসবাদী) মাসুদ রানা, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম প্রমুখ।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা আলোচনা চলবে। প্রয়োজনে এরপরও আলোচনা অব্যাহত থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলো রাজি থাকলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবারেও আলোচনা করতে রাজি কমিশন।
সংলাপ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে দুই বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। সেই দুইটা হচ্ছে আস্থা ভোট ও অর্থবিল। এই দুইটা বিষয় বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। তবে কয়েকটি দল তার সঙ্গে সংবিধান সংশোধনী বিল যুক্ত করেছে। আমাদের আরেকটা অবস্থান আছে, আমরা লিখিত প্রস্তাবে দিয়েছিলাম জাতীয় নিরাপত্তা বিষয় (যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো বিষয়) থাকলে সে ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন থাকবেন না। সিদ্ধান্ত হয়েছে- আস্থা ভোট ও অর্থবিল জাতীয় সনদে উল্লেখ থাকবে।
এখানে সবার স্বাক্ষর থাকবে। বাকি দুইটা বিষয়ে সংযুক্ত থাকবে। আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত (ক্ষমতায় গেলে) হলে বাকি দুইটা বিষয় আমরা সেখানে সংযুক্ত করতে পারব।’ তিনি বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, ইস্টিমেশন কমিটি, পাবলিক আন্ডার টেকিং কমিটিসহ আরও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে সভাপতির পদ আসনের ভিত্তিতে বিরোধী দল পাবে। নারীদের সংরক্ষিত ১০০ আসন রাখার বিষয়ে সবাই একমত বলেও জানান তিনি।