অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁর প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে বলেছেন, এটা মধ্যবিত্তেরই বাজেট। এটি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব। আমাদের সীমিত সম্পদ ও অনেক চাহিদার মধ্যেও আমরা এ বাজেট এনেছি। এটা বাস্তবায়নযোগ্য। গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অর্থ বিভাগ আয়োজিত বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামন মজুমদার। প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। প্রশ্নোত্তর পর্বে অর্থ উপদেষ্টাকে সহায়তা করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রমুখ। দর্শক সারিতে সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টা ও সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এ বাজেট জনবান্ধব : অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সামনে পথ কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি এনবিআরকে রি-অর্গানাইজ করতে। বাইরে থেকে ঋণ আনার প্রক্রিয়াটাও মোটামুটি নেগোশিয়েট করে ফেলেছি। আমি মনে করি আমরা একটি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিতে পেরেছি। অনেকে বলছেন তোমরা আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছো। হুট করেই যে আমরা একটা বিপ্লবী বাজেট দিয়ে দেব, সেটা তো সম্ভব নয়। বাজেটে একেবারে যে ইনোভেশন নেই, তা কিন্তু নয়। গতকাল (২ জুন) বাজেট দিয়েছি, এটা ওপেন থাকবে। কিছু সাজেশন আসবে। পরবর্তীতে ফাইনাল বাজেটটা আসবে।
সার্বিকভাবে আমি মনে করি চ্যালেঞ্জের মুখে আছি। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ফেলেছি ব্যাপারটা এমনও নয়। একটু কোলাবোরেটিভ, সিমপেথেটিক হয়ে কাজ করবেন; সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা চাই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যে, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাজেটের নির্যাস হলো সবার জীবনযাপনকে স্বচ্ছ করা, সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো ও জীবনমান উন্নত করা।
প্রসঙ্গ মূল্যস্ফীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের দুইটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তার মধ্যে একটি মূল্যস্ফীতি আরেকটি মুদ্রাবাজার। এখন মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে আবার বিনিময় হারও স্থিতিশীল। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। তখন সুদহারও কমানো হবে। গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি ও এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল না হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ত। এখন স্বস্তিতে এসেছে। এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের ওপরে ছেড়ে দেওয়ার পরও পরিবর্তন হয়নি, অর্থাৎ এটাও স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এতে আস্থা এসেছে। আগামীতে মূল্যস্ফীতি একটি ভালো জায়গায় যাচ্ছে।
ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা পেয়েছে : বাণিজ্য, বিমান, বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বলেছেন, সিন্ডিকেটনির্ভর বাজার ভেঙে একটি মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ফেরানো সম্ভব হয়েছে। এতে ভোক্তা স্বার্থ যেমন রক্ষা পেয়েছে, তেমনি সামগ্রিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনায় এসেছে জবাবদিহি ও ভারসাম্য।
জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটকে একটি ব্যতিক্রমী, অসংগতি কমানোর এবং অপচয় কমানোর বাজেট। তিনি বলেন, আমরা জ্বালানি বিভাগ থেকে এলপিজির দাম কমানোকে সমর্থন করছি। আমরা সড়ক বিভাগ থেকে চাঁদাবাজিকে সীমিত করার চেষ্টা করছি। আজকেই খবর পেয়েছি যারা গ্রামে বাড়ি যাচ্ছেন, তাদের থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতোমধ্যে এলপিজি ও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে। এটা বাড়ানো হবে না। ফলে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়বে।
বাজেট পুরোটাই বাস্তবায়নযোগ্য : পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। এ বাজেট অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। আমাদের চাহিদা বেশি, কিন্তু কাঠামোগত কারণে রাজস্ব আদায় করতে পারছি না। বাজেটকে অনেকে গতানুগতিক বলছে। তবে সামাজিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দ বেশি হয়েছে। বাজেট একটা চলমান প্রক্রিয়া।
প্রসঙ্গ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার জন্য সরাসরি কোনো সুবিধা রাখা হয়নি। আগের মতো কোনো বিশেষ সুযোগ নেই, তবে নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করে কেউ চাইলে তার অপ্রদর্শিত আয়কে ব্যবহারের সুযোগ থাকছে। এটা মূলত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নয়। বরং নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর দিয়ে যে কোনো অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের একটা পথ রাখা হয়েছে। এবার বাজেটে দুটি নির্দিষ্ট সুযোগ রাখা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো কেউ যদি অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে কোনো ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, তাহলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বাড়তি হারে কর দিয়ে সেটি বৈধ করতে পারবেন। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো সংস্থা যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আয়কর বিভাগ কিংবা ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তদন্ত চালাবে না। অন্যদিকে দ্বিতীয় সুযোগটি হলো যদি কেউ নিজের নামে থাকা জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থে বাড়ি নির্মাণ করেন, তাহলে তাকে দ্বিগুণ হারে কর দিতে হবে। এ অতিরিক্ত কর পরিশোধ করলেই তার বিনিয়োগ আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে সময় লাগবে : অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন বলেন, যারা অর্থ পাচার করে তারা খুবই বুদ্ধিমান। বিভিন্ন ধাপে ধাপে অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়ার টাকা ফেরত আনা অত সহজ হবে না। সময় লাগবে, তবে সরকারও চেষ্টা করে যাচ্ছে। নাইজেরিয়ার তাদের পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে ২০ বছর লেগেছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এলে হয়তো উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তার প্রয়োজন হতো না। আইএমএফের কাছে যেতে হতো না।
মানুষ অনেকটা স্বস্তিতেই আছে : স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আসন্ন কোরবানির ঈদ ও গত রোজার ঈদের বাজার তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখবেন আমরা এখন স্বস্তিতে আছি। এখন ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে যত কথা বলছি, কৃষকের অধিকার নিয়ে অতটা বলি না। এখন ভোক্তারা অল্প দামে আলু পেলেও কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। গতবারের চেয়ে এবার আমাদের সবগুলো ফসল বেশি উৎপাদন হয়েছে। আমাদের কোল্ড স্টোরেজগুলো আলুতে ভরে গেছে। কৃষকের ঘরেও আলু রয়েছে।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অনেকেরই প্রশ্ন কালো টাকা (অপ্রদর্শিত আয়) ঢালাওভাবে সাদা করতে দেওয়া হচ্ছে। কালো টাকা কিন্তু কালো টাকা নয়, অপ্রদর্শিত অর্থ। কোনো কারণে হয়তো রয়ে গেছে বা প্রদর্শন করা হয়নি। শুধু ফ্ল্যাটের বিষয়ে একটা বিধান নেওয়া হয়েছে। কালো টাকার দুটি দিক, একটা হলো টাকা বৈধ হওয়া, অন্যটি হলো সরকারের এর মাধ্যমে কিছু রাজস্ব পাওয়া। তবে বাজেটে কালো টাকার বিষয়টি ভেবে দেখা হবে।
তিনি আরও বলেন, ক্রান্তিলগ্নে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সবাই মিলে চেষ্টা করে দেশটাকে একটা স্থিতিশীল অবস্থানে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আমরা ক্ষমতা নিইনি, দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্বটা একটা কঠিন সময়ে নিয়েছি। দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। অনেকেই বলেছেন দেশ আইসিইউতে ছিল, খাদের কিনারে চলে আসছিল, বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। সে সময় যদি আমরা দায়িত্ব না নিতাম তাহলে কি হতো? যাই হোক আমরা চেষ্টা করে সবাই মিলে দেশটাকে একটা স্থিতিশীল অবস্থান নিয়ে আসতে পেরেছি। যে সংস্কারগুলো আমরা হাতে নিয়েছি সেটা চলমান। আমরা যতটুকু পারি করব। আমরা যে পদচিহ্ন রেখে যাব (ফুটপ্রিন্ট) আশা করছি পরে যারা আসবে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে। এবারের বাজেটে কথার ফুলঝুরি নেই। আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল যেমন- মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাত, জ্বালানি খাত, রাজস্ব আদায় এসব কিছুর মধ্যেই বাজেট করতে হয়েছে। তার পরও আমাদের প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার বাড়েনি। তিনি আরও বলেন, এত দিন তো আপনারা প্রবৃদ্ধির ন্যারেটিভ শুনেছেন। গ্রোথ হয়েছে অনেক বেশি কিন্তু সেটার সুবিধা কে পেয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হয়, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, ব্যবসাবাণিজ্য যাতে চালিয়ে যেতে পারে- সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজেট সাজিয়েছি।