গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করেছিল আমার প্রতিষ্ঠান। সৌজন্য প্রকাশ করার মতলবেই ‘আমার’ বলি। প্রকৃতপক্ষে আয়োজক ছিল আমি ২০১৩ সালে যে প্রতিষ্ঠানের চাকুরে ছিলাম সেই প্রতিষ্ঠান। ওই গোলটেবিলের মডারেটর ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদ আল ফয়সাল। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় একটি মিলনায়তনের সেই গোলটেবিল আলোচনার একেবারে শেষ ভাগে হাজির হই। দেখি, ক্রেতাসাধারণের দুর্ভোগমোচনের জন্য করণীয় বিষয়ে জ্ঞান-বিতরণ করছেন এক পণ্ডিত। আমার পাশে দাঁড়ানো শ্রোতার কাছে জানতে চাইলাম বক্তার পরিচয়। তিনি বললেন, নাম তো ভুইলা গেছি। ইনি চিফ গেস্ট এইডা মনে আছে। পরিচয় দরকার ক্যান? কোনো প্রবলেম হইতেছে?
‘না। কোনো প্রবলেম হচ্ছে না। ওনার লেকচার এত্ত সুন্দর! শুনতে শুনতে শরীরের ঢিলে যত নাটবল্টু আছে সব টাইট হয়ে যাচ্ছে’-আমার মন্তব্য শুনে পড়শি শ্রোতা বলেন, জ্বে! ঠিকই কয়েছেন। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই...।
পড়শি শ্রোতার আরও দুই পড়শি শ্রোতা ফিক্ ফিক্ ফিকির হাসতে শুরু করলে ভড়কে যাই। তবু কুছ পরোয়া নেহি ভঙ্গিতে বলি, হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না। পড়শি শ্রোতা বলেন, ওই যে কথায় আছে না! বুদ্ধিমানের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট। সেই কেস্ আর কী! ‘তোরে জুতানো দরকার’ না কইয়া ইঙ্গিতে বলি-ফুলের গন্ধে...। এই আঁতেলের বক্তৃতা শুইন্না আপনার যেরকম বমনেচ্ছা জাগ্রত হইতেছে, আমাদের তিনজনেরও ওই একই টেনডেন্সি হচ্ছে।
বক্তৃতা শুনে বমির ইচ্ছা জেগে ওঠে, এমন তথ্য এর আগে কখনো পাইনি। পড়শি শ্রোতা আরও জানান, ইশারা-ইঙ্গিত জিনিসটা খুব উপকার দেয়। সবার সামনে ইঙ্গিতে এমন সব কথা উচ্চারণ করা যায়, যেসব কথা আওয়াজ দিয়ে সরাসরি বললে দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। ‘নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নাও’ বললে পুলিশি অ্যাকশনে ঠ্যাঙানি খাওয়ার শঙ্কা। কিন্তু নিন্দনীয় ওই প্রস্তুতির ইঙ্গিত ‘পুষ্পবৃষ্টির প্রস্তুতি চাই’ উচ্চারণে দিলে ধরতে পারে কেউ?
আলোচনা শেষ হওয়ার পর বক্তাদের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজ। প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন আমাকে খুঁজতে থাকেন। তাঁরা আমায় টেনেটুনে খানাঘরে নিয়ে গেলেন। ওখানে মাহমুদ আল ফয়সালকে পেয়েই উচ্চকণ্ঠে ‘অপদার্থদের শিরোমণি কিসিমের’ একটা লোককে প্রধান অতিথির আসনে বসানোর বুদ্ধি তাকে কে দিয়েছিল জানতে চাই। এবং ভয়ংকর কর্ণপীড়াদায়ক মাধুর্যরহিত বক্তৃতার জন্য লোকটাকে ছাগলের লাদা দিয়ে বানানো পদকে শোভিত করার প্রস্তাব তুলতে যাওয়ার আগেই ফয়সাল চটজলদি ছুটে এসে কানে কানে বলেন, ‘খাবার টেবিলে আমার ডানে বসা লোকটাই চিফ গেস্ট। আল্লার ওয়াস্তে খ্যামা দেন ভাই। প্লিজ! আমারে আর বিব্রত কইরেন না।’
বক্তার চেহারা আমার মনে ছায়াপাত করেনি। করেছিল তাঁর অখাদ্য ভাষণ। তাই চেহারাটা মনে থাকেনি। সেজন্য খাবার টেবিলে উপস্থিতি সত্ত্বেও তার প্রসঙ্গে বিষোদগারকর্মে সমস্যা হয়নি। প্রধান অতিথি দেখেও না দেখার, শুনেও না শোনার ভান করলেন এবং মজাসে চর্ব্যচূষ্যলেহ্যপেয়র সদ্ব্যবহার করলেন।
২. পাকিস্তানি জমানায় কলেজে পড়ুয়া আমরা পাঁচ বন্ধু নোয়াখালী থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় যাব। লাকসাম স্টেশনে নেমে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ‘উল্কা’ ট্রেনে উঠতে হতো। প্ল্যাটফর্মে বিপুলসংখ্যক যাত্রী উল্কায় ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ। ট্রেন এলো আর ওটার ভিতরে ঢোকার জন্য যেন যুদ্ধ শুরু হলো। এই বগিতে উঠতে গেলাম, ওই বগিতে উঠতে চাইলাম, ভিতরে আগে থেকে বসা ও দাঁড়ানোরা সমস্বরে বলে, ‘জায়গা নাই, জায়গা নাই।’ এরকম বলাটা বাকস্বাধীনতা। বলতেই পারে, বলুক না। কিন্তু নাই নাই বলার সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা মেরে চিৎপাত ফেলে দিতে চাইছে।
লাকসামে উল্কার যাত্রাবিরতি পাঁচ মিনিট। তিন মিনিট পার হলে ভেঁপু বাজল। আরও দুবার ভেঁপু শোনা যাবে-চার ও পাঁচ মিনিট হয়ে গেলে। দ্বিতীয় ভঁপু বাজতেই আমাদের বগি সন্ধান জোরদার হয় কিন্তু কাঙ্ক্ষিত তৃতীয় শ্রেণির বগির দেখা মেলে না। আবদুল করিম মিন্টু হাঁক দেয়, টাইম শেষ! যে কোনো বগিতে উঠে যেতে হবে। একটা বগির দরজা ফাঁকা পেয়ে মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (মৃত্যু : ০৯.১০.২০২৩) হাঁক দেয় ‘এদিকে! এদিকে আয়! এটায় উঠে পড়।’
শেষ ভেঁপু বাজাতে বাজাতে সচল হয় উল্কা। আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটন্ত ট্রেনের উদরে প্রবেশ করলাম। কী আরাম। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে মাহবুব আলম খোকন। সবুজ রেক্সিনে মোড়া ফোমসজ্জিত আসনে গা এলিয়ে দিতে না দিতেই টের পাই, ওরে আল্লাহ! উঠেছি কোথায়! এ তো ফার্স্ট ক্লাস! আমরা তো কেটেছি থার্ড ক্লাসের টিকিট।
নোয়াখালী টু ঢাকা ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া ২৭ টাকা। থার্ড ক্লাসের ৭ টাকা। চলন্ত ট্রেনের অবাঙালি টিকিট চেকার আমাদের হাতেনাতে পাকড়াও করে বলেন, আপনাদের জার্নি ইল্লিগাল আছে। শরম হওনা চাহিয়ে। একসো পনেরো রুপিয়া দিজিয়ে। কেরায়া আউর জরমানা দেড়সো রুপিয়া। মাইনাস পঁয়ত্রিশ রুপিয়া। ওটা আপনাদের টিকিটের দাম অ্যাডজাস্ট করে দিলাম। টিকিট চেকার রিসিট বই বের করে পান চিবোতে থাকলেন। আমরা মতবিনিময় করতে থাকি এবং সিদ্ধান্তে আসি যে রেলওয়ের এই কর্মকর্তার সঙ্গে সাধ্যমতো ‘প্রসিদ্ধ ব্যবহার’ করতে হবে। শাহ আকবর চানধন পাঁচ টাকার কড়কড়ে পাঁচখানা নোট এগিয়ে দেয়। চেকার সহাস্যে নোটগুলো নেড়েচেড়ে দেখে বলেন, লোটের তসবিরে পাট বোঝাই নাও (নোটের ছবিতে পাটভর্তি নৌকা) খুবসুরাত আছে। নাও-এর বদলায় শালিমার বাগ থাকলে জেয়াদা খুবসুরাত হোবে। আপনারা কী বোলেন?
দশ টাকার নোটে তখন লাহোরের বিখ্যাত শালিমার বাগের ছবি থাকত। ‘আমায় পাঁচটি দশ টাকার নোট দাও’ না বলে, টিকিট চেকার ‘জেয়াদা খুবসুরাত’ বর্ণনা করছেন। ইঙ্গিতে নিজের প্রত্যাশা বুঝিয়ে দেওয়ার শৈল্পিক কায়দা বটে। আমরা তাঁকে একটা শালিমার বাগ অর্পণ করি। ঢাকা স্টেশনের গেটের চেকারের কাছে আমাদের অর্পণ করার সময় তিনি বলেন, ইনারা স্টুডেন্ট আছেন। ইনারা সার্টিফায়েড প্যাসেঞ্জার আছেন।
অর্থাৎ এই ছাত্ররা আমায় ‘ইয়ে’ দিয়ে দিয়েছে। এদের সঙ্গে হুজ্জত কোরো না। থার্ড ক্লাসের টিকিট দেখিয়ে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম।
৩. শুনে যেমন ইশারা পাওয়া যায়, দেখেও তেমনই। এ বিষয়ে চমৎকার বলে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জননেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।
১৯৪৫ সালের আগস্টে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা বর্ষণ করে। এতে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়; আহত হয় লাখ লাখ। বোমার তেজস্ক্রিয়া আহতদের থেকে সন্তানদের মধ্যে সঞ্চালিত হওয়ায় তাদের বংশধররা এখনো রক্তের ক্যানসারসহ নানা রকম রোগে ভুগে চলেছে।
মার্কিনিরা বলে বেড়ায় : ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য জাপানে বোমা মারা হয়েছে। জার্মানি আত্মসমর্পণ করে ৮ মে। কিন্তু তার মিত্র জাপান যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতেই আণবিক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তিকে ‘ফালতু’ বলে অভিহিত করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি ২০০৩ সালে এক অনুষ্ঠানে ভাষণকালে বলেন, জাপানি সেনারা যখন সব রণাঙ্গন থেকে পিছু হটছিল তখন বোমা মারার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে চোখ রাঙানো। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র লাখ লাখ নিরীহ জাপানিকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বলতে চেয়েছে, ‘আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করলে আমরা কী করি দেখলে তো! দুনিয়ার এখানে-ওখানে আমরা যা করছি তার বিরুদ্ধে যদি কিছু কর, তাইলে জাপানের যে দশা আমরা করেছি, তোমাদেরও সেরকম দশা করে ছাড়ব।’
ম্যান্ডেলা বলেন, ‘শক্তিমত্তা প্রদর্শনে তারা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে জাপানের নির্দোষ বেসামরিক মানুষের ওপর তারা গণহত্যা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর এখন তারা বিশ্বময় শান্তি রক্ষার মোড়লিপনার ভান করছে। তারা কে? মোড়লগিরি করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?’
৪. মোটরবাইক চালানোর বিদ্যা হাসিলের পর যে বয়সটায় ‘দেখ, দেখ কী সুন্দর পারি’ বিমারে ভুগেছি, সেই সময় ইশারায় বাতচিতের মাধ্যমে আট-দশটি স্কুলছাত্রী যা করেছে তা ভেবে এখনো হাসি।
বাইকের পেছনে বসা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বোনঝিকে স্কুলে পৌঁছানোমাত্রই ভাগনির সহপাঠী আট-দশটা মেয়ে হাসতে হাসতে একযোগে সুরেলা গলায় বলে, ‘চিশা চিহি চিনে চির চিমা চিমা চির চিফু চিটা চিনি।’ ভাগনি রুষ্ট কণ্ঠে বলে, ‘চিতো চিরা চিগু চিখা।’ একটি মেয়ে তখন বলে, ‘মজা করে কিছু বললে এত রেগে যাওয়া ঠিক নয় বন্ধু।’ পরক্ষণে সেই মেয়েটি আমায় বলে, ‘কিচ্ছু না মামা, আপনি যান।’
পরে জেনেছি, দ্রুতগতির বাইককে স্কুল বারান্দার কাছে নিয়ে কায়দা করে নিজের বাম পা বারান্দায় রাখায় আমার উদ্দেশে ওদের সাংকেতিক মন্তব্য ছিল-‘শাহীনের মামার ফুটানি।’ মন্তব্যে ব্যবহৃত ‘চি’গুলো আসল জিনিসকে আড়াল করে রেখেছে। রেগে গিয়ে ‘চি’ সংযোগে শাহীন যা খেতে বলেছে তা কোনোমতেই স্বাভাবিক খাদ্য নয়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এক উপন্যাসে আছে, নায়িকা কলেজছাত্রী। নায়ক ভেসপা স্কুটারে বসিয়ে নায়িকাকে কলেজ গেট পর্যন্ত নিয়ে নামিয়ে দেয়। কলেজ ভবনের দোতলা থেকে অন্য মেয়েরা তা দেখে বলে, ‘চিলা চিভা চির।’ ওদের কথায় নায়িকা কিন্তু রাগেনি। সে দোতলার দিকে সহাস্যে তাকিয়ে চপেটাঘাত করার ভঙ্গি করে।
আওয়াজ ছাড়াও অনেক কিছু ইশারা করা যায়। সে বিষয়ে কাহিনি নির্মাণে রাশিয়ার অধিবাসীদের রয়েছে ঈর্ষণীয় মুনশিয়ানা। কাহিনিগুলোর চমৎকারিত্ব বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন জানোয়ার। আজ এখানে ভালুক সাহেবের ‘নীরবতা’ পরিবেশন করছি।
রেস্তোরাঁয় ঢুকেছে খরগোশ ও ভালুক। টেবিলে বসে তারা এদিক-ওদিক তাকায়, বেয়ারা দেখে না। টেবিলে মুষ্টাঘাত করে ভালুক। বেয়ারা ছুটে আসে। বলে, কী দেব স্যার।
খরগোশ বলে, ‘আমার জন্য সাতটা পরোটা, সাতটা সেদ্ধ ডিম, এক বাটি হালুয়া আনো। জলদি।’ অর্ডার কাগজে টুকে নিয়ে কিচেনের দিকে ছোটে বেয়ারা। মাঝপথ থেকে ফিরে এসে সে বলে, শুধু আপনার জন্য বললেন। ভালুক স্যার খাবেন না? ওনার কি খিদে নেই!
‘ওরে আহাম্মক!’ বলে খরগোশ, ‘দুজন একসঙ্গে এলাম। বসলাম। এটা দেখেও তো বুঝতে পারতিস যে ভালুক সাহেবের পেট ভরা বলেই আমি আস্ত রয়েছি।’
লেখক : সাংবাদিক