চলচ্চিত্র নির্মাতা, সরকারি প্রকল্পের পরিচালক কিংবা ড্রাইভারের মতো সাধারণ পেশার ক্ষেত্রে আয় সীমিত। তবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কয়েকটি পৃথক তদন্তে দেখা গেছে, সীমিত আয়ের আড়ালে অনেকেরই সম্পদের পাহাড়। বিপুল পরিমাণ অর্থ, বিদেশে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত তারা।
বিএফআইইউ বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরলেও তদন্তের স্বার্থে জড়িতদের পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন সরকারি কর্মকর্তার মা ও আত্মীয়ের নামে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বেতনের বাইরে তার কোনো আয় না থাকলেও একটি অ্যাকাউন্টে তার জমা হয়েছিল ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ অ্যাকাউন্ট স্থিতি ছিল ৮২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ওই কর্মকর্তার মায়ের নামে উপকূলীয় অঞ্চলে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে, যার অ্যাকাউন্টে দেড় বছরে ৭ কোটি টাকার বেশি জমা হয়েছে। এসব অর্থের উৎস ছিল ঢাকা। তদন্তে ওই আমলা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৭৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে বিএফআইইউ। যেগুলোতে নিয়মিত বড় অঙ্কের নগদ জমা ও স্থায়ী আমানতের মাধ্যমে সিকিউরড ওভারড্রাফট সুবিধা নেওয়া হয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, কর্মকর্তা তার পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন এবং গোপন করেছেন। সরকারি ড্রাইভারের অ্যাকাউন্টে কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন সরকারি ড্রাইভার এবং তার গৃহিণী স্ত্রীর ব্যাংক ও বিও অ্যাকাউন্টে ২০২২ সালের মে থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল সময়ের মধ্যে ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা জমা হয়। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি সময়ে ৬০ লাখ টাকার এফডিআর করেন এবং ৯০ লাখ টাকা বিও অ্যাকাউন্টে গ্রহণ করেছেন ড্রাইভার। এ ছাড়াও তার স্ত্রী ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ১ কোটি টাকার এফডিআর করেন এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিও অ্যাকাউন্টে পান ১ কোটি টাকা। অথচ ড্রাইভারের মাসিক বেতন ২৯ হাজার ৩৭৬ টাকা এবং তার বেতনের অ্যাকাউন্টেও অনিয়মিত লেনদেন। তদন্তে ড্রাইভারের ভাইয়ের নাম এসেছে, যিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে ড্রাইভারের ভাই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন এবং তা ভাই ও ভাবির অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পাচার করেছেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) একটি উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালকের অ্যাকাউন্টে শত কোটি টাকার সন্ধান পেয়েছে বিএফআইইউ। তার নামে থাকা ৮২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ৭০ কোটি ১৫ লাখ টাকা জমা হয়েছে। অথচ তার ঘোষিত বার্ষিক আয় মাত্র ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়াও তিনি ৩০ কোটি ৭১ লাখ টাকার এফডিআর করেছেন। বিদেশে সন্তানদের লেখাপড়ায় অর্থ ব্যয় করছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে প্রকল্প পরিচালকের আয় ও সম্পদের মধ্যে বড় ধরনের গরমিল পাওয়া যায়। আয়কর রিটার্নে ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে, যা প্রকৃত অর্থের তুলনায় অনেক কম। তদন্তকারীদের মতে, এই অর্থ দুর্নীতি, ঘুষ এবং সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অর্জিত। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও কোটি টাকা লেনদেন করেছেন এক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তার কন্যা। এই নির্মাতার কন্যা এবং তার বোনের নামে বাংলাদেশে ১৫৯টি অ্যাকাউন্টে ৪৩৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা জমা এবং ৪১৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা উত্তোলনের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। এ ছাড়া তাদের নামে বিদেশে কোম্পানি নিবন্ধন ও অ্যাকাউন্ট পরিচালনার তথ্য পেয়েছে। বাবা এবং মেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ছয়টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক। বিদেশি অ্যাকাউন্টে জমা ৬ লাখ ডলার। হুন্ডির মাধ্যমে এসব অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে এসব বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে বিএফআইইউ।