হাওক দেখানোর চেষ্টা করেন কীভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাটপিসগুলো সিনেমা হলে দর্শক টানায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং সুস্থধারা থেকে বেরিয়ে এসে গোটা চলচ্চিত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার খোলস পাল্টে দিয়েছিল। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে ‘খুনী মিন্টু’ ছবির চিত্রনাট্য তৈরির প্রক্রিয়ার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে চিত্রনাট্যকার একটি বাস্তবসম্মত কাহিনি দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও প্রযোজকের মনষ্কামনার কাছে তা হার মেনে যায়
২০০৫ সালের কথা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে সেন্সর শো চলছিল ‘হীরা আমার নাম’ শিরোনামের একটি ছবির। এ সময় সেন্সর বোর্ডের অন্যতম সদস্য অভিনেত্রী ববিতা ছবিটির সেন্সর শো বন্ধ করে এ ছবিটিকে নিষিদ্ধ করতে বলেন। এতে ছবিটির নির্মাতা শরীফউদ্দিন খান দীপু ক্ষিপ্ত হয়ে ববিতার ওপর চড়াও হন। ববিতা সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ছবিটির প্রতিটি দৃশ্য এতটাই অশ্লীলতায় ভরা ছিল যে, এ ছবি দেখার উপযুক্ত ছিল না। তাই আমি ছবিটি কিছুটা দেখার পর এটির সেন্সর শো বন্ধের ও ছবিটি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম। আর এতেই ছবিটির নির্মাতা দীপু আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল। যা মনে পড়লে আজও আমি লজ্জায় মুখ নিচু করি।’ আসলে দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কমপক্ষে ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়কে বাংলা সিনেমার অন্ধকার যুগ বলা হয়। এ সময় কমপক্ষে ৫০০ অশ্লীল সিনেমা তৈরি হয়। এসব সিনেমার ধরন ছিল প্রায় অভিন্ন। ধর্ষণ, নারী জাতিকে নিচু করা এবং নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো এসব সিনেমার গল্পে। এসব সিনেমার মধ্যে দুর্র্ধর্ষ কোপা, নষ্ট মেয়ে, ফায়ার, হীরা আমার নাম, মহিলা হোস্টেল, বস্তির রাণী সুরাইয়াসহ অনেক নাম সহজেই সামনে আসে। অশ্লীলতার কারণে অনেক গুণী পরিচালক সিনেমা তৈরি থেকে তখন সরে আসতে শুরু করেন, এদের মধ্যে রাজ্জাক, আমজাদ হোসেন, এ জে মিন্টু, শহীদুল ইসলাম খোকন, চাষী নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, মতিন রহমান, দিলীপ বিশ্বাস অন্যতম। অশ্লীল সিনেমাগুলো মূলত ক্ষমতার জোরেই রাতের অন্ধকারে তৈরি হতো। অশ্লীল সিনেমার উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নির্মাতা ছিলেন- বাদশা ভাই, অপূর্ব রানা, শরীফউদ্দিন খান দীপু, এনায়েত করীম, ইস্পাহানি আরিফ, স্বপন চৌধুরী প্রমুখ। জানা গেছে, এ জাতীয় সিনেমায় সব সময় যে নায়ক-নায়িকারা স্বেচ্ছায় অশ্লীল অভিনয় করত তা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ করানোর পরে জোর করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে বা চুক্তির আইনি ভয় দেখিয়ে কাপড় খুলতে বাধ্য করা হতো। অনেক শিল্পী টাকা বা টিকে থাকার জন্য বাধ্য হতেন এ কাজে। কখনো তাদের ব্ল্যাকমেল করা হতো। মূলত এর জন্য দায়ী ছিল তৎকালীন সিনেমামুখী কয়েকটি সিন্ডিকেট। তখন দেশের প্রায় সব প্রোডাকশন হাউস এ ধরনের সিনেমা নির্মাণ করেছে। আর অশ্লীল সিনেমার শিল্পীদের তালিকায় এগিয়ে ছিলেন ডিপজল, মুনমুন, পলি, ময়ূরী, শাহিন আলম, আলেকজান্ডার বো, নদী, ঝুমকা প্রমুখ।
যতদূর জানা যায়, পরিচালক এফ কবির চৌধুরী অঞ্জু ঘোষকে নিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের দর্শকদের খোলামেলা দৃশ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বৃষ্টিতে ভিজে গান। তার হাত ধরেই অঞ্জু ঘোষের সিনেমায় আগমন ঘটে। এফ কবির বেশ কিছু ভালো সিনেমাও নির্মাণ করেছেন। মূলত তিনি অশ্লীল যুগের নির্মাতা নন। পরে আবুল খায়ের বুলবুল নব্বই দশকজুড়ে ছবিতে বিভিন্ন সময়ে অশ্লীলতার নামে গোসলের দৃশ্য দেখানো শুরু করলেন। স্বল্প বাজেটের এসব সিনেমাতে যৌনতা থাকার কারণে ব্যবসায়িক লাভও এসেছে। মোহাম্মদ হোসেন ‘অবুঝ দুটি মন’ ছবিতেও এ চর্চাটা চালিয়ে গেলেন। এ সিনেমায় প্রথম বাংলাদেশের কোনো নায়িকাকে সুইমিং পুলে গোসলের দৃশ্য দেখানো হলো। নায়িকা ছিলেন মডেল রথি। আবুল খায়ের বুলবুলের ‘অন্যায়-অত্যাচার’ ছবিতে পাহাড়ি ঝরনায় গোসলের দৃশ্যের ট্রেন্ড শুরু হলো। মোহাম্মদ হোসেন পরে বানালেন ‘রাঙা বউ’। আমিন খান, ঋতুপর্ণা, হুমায়ূন ফরীদি অভিনীত এ সিনেমাটি ছিল অশ্লীলতায় পূর্ণ। এনায়েত করিমের ‘জননেতা’ ছবিতে প্রথমবার বাংলাদেশে সরাসরি নায়িকার উন্মুক্ত বক্ষ প্রদর্শন করা হলো। এনায়েতের ‘কদম আলী মাস্তান’ও অশ্লীলতার দিক দিয়ে স্মার্ট। তার ‘ভয়াবহ’ ছবিতে বি-গ্রেডের নায়িকার আমদানি ঘটল। শরীফুদ্দিন খান দিপু আরও বানিয়েছিলেন ‘বাঁচাও দেশ’, ‘পুলিশ অফিসার’র মতো অশ্লীল সিনেমা। অশ্লীল যুগের সিনেমা বানাতেন মূলত এনায়েত করিম, মোহাম্মদ হোসেন (ফায়ার), কালাম কায়সার, শরীফুদ্দিন খান দিপু, স্বপন চৌধুরী, শাহাদাৎ হোসেন লিটন (কঠিন শাস্তি), রাজু চৌধুরী, এম এ আউয়াল, এম বি মানিক (জাদরেল), উত্তম আকাশ, এ জে রানা, নাদিম মাহমুদ, রাকিবুল আলম রাকিবসহ অনেকে।
ঢাকাই অশ্লীল সিনেমা নিয়ে বিদেশি গবেষণা
২০০৫ সাল। শাহাদাৎ আলি শিপলু পরিচালিত ‘খুনী মিন্টু’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। ছবিটিতে বাংলাদেশি নায়িকাদের পর্নোগ্রাফি দৃশ্য ছিল। ফলে ছবিটির নামের সঙ্গে ‘অশ্লীল’ তকমা লেগে যায় এবং সারা দেশে রংপুর, খুলনা থেকে শুরু করে যশোর, সিলেট সর্বত্র ছবিটির টিকিট বিক্রি হু হু করে বেড়ে যায়। ২০০৫ সালের শেষ দিকে ছয় সপ্তাহ হলে চলার পরই ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ‘অশ্লীল’ ও ‘কুরুচিপূর্ণ’ দৃশ্য থাকার দায়ে বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড কর্তৃক ছবিটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময় বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে এসব কাটপিসের উপস্থিতি এবং অশ্লীলতা উপজীব্য করেই ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘Cut-Pieces: Celluloid Obscenity and Popular Cinema in Bangladesh’ শীর্ষক বইটি, যার রচয়িতা লোটে হাওক। লোটে হাওক এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক নৃতত্ত্ব বিভাগের একজন ফ্যাকাল্টি সদস্য। তাঁর মূল আগ্রহের বিষয় গণমাধ্যম ও নৃতত্ত্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমের সঙ্গে এ অঞ্চলের নৃতত্ত্বের যে গভীর যোগাযোগ রয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা। সেটির অংশ হিসেবেই তিনি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে কাটপিস সংযোজন ও অশ্লীলতা নিয়েও গবেষণা করেছেন। এ গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে তার রচিত গবেষণাপত্রটিই পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ করে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস। অন্য অনেক ইউরোপিয়ানের মতো, হাওকের শখ ছিল পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখার। তবে হাওক ব্যতিক্রম এখানেই যে, গ্র্যাজুয়েশনের পর কোনো উন্নত দেশে থিতু হওয়ার বদলে তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। এখানে এসে তিনি বাংলাদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন এবং তার মনে এতটাই মুগ্ধতা জন্মে যে, তিনি বাংলা ভাষাটাও শিখে ফেলেন। ফলে যখন সময় আসে মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য গবেষণার বিষয় ঠিক করার, তিনি মনস্থির করেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি নিয়েই কাজ করার। হাওক তাঁর গবেষণার ব্যাপারে এতটাই নিবেদিত ছিলেন, পুরো দশটি মাস তিনি সময় কাটান একটি ফিল্ম ক্রুর সঙ্গে। এরপর তিনি শুরু করেন বাংলা ছবি দেখা। সিনেমা হলে গিয়ে চলমান ছবিগুলো তো তিনি দেখতেনই, পাশাপাশি ভিসিডিতেও দেখতেন অপেক্ষাকৃত পুরোনো ছবিগুলো। গবেষণার কাজে তিনি প্রায় পুরো বাংলাদেশই চষে বেড়ান। যশোর, খুলনা, সিলেট, রংপুর তো রয়েছেই, পাশাপাশি জয়পুরহাট, ফেনী, কুড়িগ্রাম, ভুরুঙ্গামারী- কোথায় পা পড়েনি তার? হাওক তাঁর গবেষণায় মূলত চেষ্টা করেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ‘অস্থিতিশীল’ দিকটির ওপর আলোকপাত করতে। এই অস্থিতিশীলতা তৈরির পেছনে যেমন সমসাময়িক বাংলাদেশি গণমাধ্যম ব্যবস্থার একটি প্রভাব ছিল, তেমনই সেটি আরও প্রকট রূপ ধারণ করেছিল ছবির মাঝে মাঝে কাটপিস সংযোজনের মাধ্যমেও। তিনি জানার চেষ্টা করেছিলেন সেন্সরশিপ নীতিমালাকে পাশ কাটিয়ে নির্মাতারা কেন তাদের ছবিতে ‘অশ্লীল’ দৃশ্য ঢোকানোর চেষ্টা করতেন। ‘খুনি মিন্টু’ ছবিটির মাধ্যমে হাওক তার কেস স্টাডি সাজান এবং এর মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেন কীভাবে ‘কাটপিস ফেনোমেনন’ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে একটি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনীয়’ রূপ ধারণ করেছিল, যেখানে কাটপিস সংযোজন ছিল বৈশ্বিক গণমাধ্যমের আধিপত্যের বিপরীতে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পক্ষ থেকে একটি পাল্টা আক্রমণের প্রচেষ্টা। হাওক দেখানোর চেষ্টা করেন কীভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাটপিসগুলো সিনেমা হলে দর্শক টানায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং সুস্থধারা থেকে বেরিয়ে এসে গোটা চলচ্চিত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার খোলস পাল্টে দিয়েছিল। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে ‘খুনী মিন্টু’ ছবির চিত্রনাট্য তৈরির প্রক্রিয়ার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
এখানে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে চিত্রনাট্যকার একটি বাস্তবসম্মত কাহিনি দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও প্রযোজকের মনষ্কামনার কাছে তা হার মেনে যায়। প্রযোজকের ইচ্ছাতেই চিত্রনাট্যে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু যৌনোদ্দীপক দৃশ্য সংযোজিত করতে বাধ্য হন চিত্রনাট্যকার। এক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন মিলে চিন্তাভাবনা করে ঠিক করা হয় চিত্রনাট্যটি কীভাবে সাজালে, মাঝে মাঝে কাটপিস সংযোজনের প্রক্রিয়াটিও অপেক্ষাকৃত সহজতর হয়। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের একটি কলঙ্কিত সময়কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে হাওকের বইটি একটি অসামান্য দলিল। কেউ যদি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে কাটপিস ও অশ্লীলতার উৎপাতের স্বরূপ জানতে চান, আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে চান ঠিক কী কারণে ‘ঢালিউড’ মৌলিকতা, সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা, বিষয়গত প্রাচুর্যের মতো বিষয়গুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে অশ্লীলতার জোয়ারে গা ভাসিয়েছিল, তাদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য।