গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বঘোষিত কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ভাসানী জনশক্তি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। গতকাল বিকালে একাধিক বিবৃতি দিয়ে দলের নেতারা এ নিন্দা জানান।
বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতকারীরা আবারও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। এনসিপির পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির ওপর বর্বরোচিত হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইউএনওসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ সদস্যদের আহত করার বর্বর ঘটনা সেই অপতৎপরতারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কারণে আওয়ামী দোসররা মরণকামড় দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা এখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এসব দুষ্কৃতকারীকে কঠোর হস্তে দমন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে খুনি শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হয়েছে। কিন্তু দেশ এখনো ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়নি। পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়েছেন। তারা দেশকে আবারও অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালাচ্ছেন। তারা নানা অপতৎপরতা চালিয়ে ফায়দা হাসিল করতে চান। তারই অংশ হিসেবে আজ এনসিপির পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, ভাঙচুর চালিয়েছে।
এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্বঘোষিত ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সন্ত্রাসী দোসররা হামলা চালিয়েছে। এনসিপির নেতারা স্বাভাবিক নিয়মে প্রশাসনের সঙ্গে পূর্ব থেকেই আলাপ আলোচনা করে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা চেয়েছে। যে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। এটি উদ্বেগজনক। গোপালগঞ্জ বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জেলা নয়। এটি বাংলাদেশেরই অংশ। সরকারকে গোপালগঞ্জসহ বাংলাদেশের সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এনসিপির পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, ভাঙচুর চালিয়েছে। এ ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আমি তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি এবং আওয়ামী দুর্বৃত্তদের এ সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এক বিবৃতিতে এলডিপির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, গোপালগঞ্জ জেলায় এনসিপির পূর্বঘোষিত ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে পতিত স্বৈরাচারের দোসর নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নৃশংস হামলা চালিয়েছে। তারা এনসিপির নেতৃবৃন্দকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের গাড়িতে হামলা করে এবং তাদের অবস্থানস্থল এসপির অফিসেও হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের হামলায় এনসিপির বহু সংখ্যক নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণ আহত হয়েছেন। সন্ত্রাসীরা অগ্নিসংযোগ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। তাদের সৃষ্ট সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম এক বিবৃতিতে বলেন, গোপালগঞ্জে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান নেতৃত্বের ওপর হামলায় অংশ নেওয়া স্বৈরাচারের দালালদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীনে থাকা একটি জেলা। সারা বাংলাদেশ যখন একযোগে স্বৈরাচারী হাসিনাকে উৎখাত করেছে, তখন গোপালগঞ্জে হাজার-হাজার খুন, গুম ও হাজার কোটি টাকা পাচারকারী শক্তির পক্ষে কেউ প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতৃত্বের ওপর হামলা করবে এবং তাদের অবরুদ্ধ করে রাখবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুততার সঙ্গে অবরুদ্ধ নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং তাদের উদ্ধার করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এক বিবৃতিতে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচার গত বছর ৫ আগস্ট পলায়ন করতে বাধ্য হয়। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীরা এনসিপির পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে। এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি- এরই মধ্যে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ; তারা সন্ত্রাসী হামলা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। অবিলম্বে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।
এক বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরও গণহত্যাকারী দলের সন্ত্রাসীরা দেশে নৈরাজ্য ও সহিংসতার মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পরিকল্পিত হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলো, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ থেকেই স্পষ্ট হয়, এখনো প্রশাসনের একটি অংশ ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে কাজ করছে। আমরা এ বর্বর হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।
অপর এক বিবৃতিতে ১২ দলীয় জোটের নেতারা বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট দোসররা এখন মরণকামড়ে নেমেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে তারা দেশে অরাজকতা ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। এসব দুষ্কৃতকারীকে কঠোর হস্তে দমন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। জোট নেতারা অভিযোগ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সুযোগে আওয়ামী দোসররা এখন মরণকামড় দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও গোটা দেশকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। এদের কঠোর হস্তে দমন করা এখন সময়ের দাবি। ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু এক বিবৃতিতে হামলায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো গাফিলতি থাকলে তা তদন্ত করতে বলেন। তিনি রাজনৈতিক সহিংসতা পরিহার করে জনগণের কল্যাণে কাজ করার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ এ ঘটনাকে ন্যক্কারজনক, গণতন্ত্রবিরোধী ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ধারায় জনগণ যখন স্বাভাবিকভাবে ফিরতে চাইছে তখন একটি গোষ্ঠী পলাতক নেত্রীর ইন্ধনে দেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আজকের গোপালগঞ্জে এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা তারই অংশ।
গোপালগঞ্জে হামলা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক : দেশের চলমান পরিস্থিতি ও গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল রাতে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠক সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ এবং গাড়িবহরে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতকারীরা আবারও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির ওপর বর্বরোচিত হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইউএনওসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ সদস্যদের আহত করার বর্বর ঘটনা সেই অপতৎপরতারই বহিঃপ্রকাশ।’
এ ছাড়া বৈঠকে আলোচিত বর্বরোচিত সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীরবিক্রম) ও ডা. এ জে ড এম জাহিদ হোসেন।