সিরিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। যার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্রুজ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সুয়েইদা। ১৩ জুলাই (রবিবার) এক দ্রুজ বণিকের অপহরণের ঘটনায় এই সহিংসতার সূত্রপাত, যা দ্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি বেদুইন যোদ্ধাদের মধ্যে একাধিক প্রাণঘাতী সংঘর্ষে রূপ নেয়।
সিরিয়ার মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান অবজারভাটরি ফর হিউম্যান রাইটস-এর তথ্য অনুযায়ী, রবিবার থেকে মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) পর্যন্ত শুধু সুয়েইদা প্রদেশেই কমপক্ষে ৩০০ জন নিহত হয়েছেন। উত্তেজনার এই মুহূর্তে ১৫ জুলাই ইসরায়েল সামরিক হস্তক্ষেপ করে, যার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা দ্রুজ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সরকারি বাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে এই সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৬ জুলাই আরও বড় পরিসরে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সামরিক সদর দফতরে আঘাত হানে। হামলার কিছু মুহূর্ত সিরিয়ার জাতীয় টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হয়, যেখানে এক উপস্থাপককে আতঙ্কিত হয়ে স্টুডিও থেকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
দ্রুজ কারা?
দ্রুজরা মূলত আরবিভাষী একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যাদের ধর্মবিশ্বাস শিয়া ইসলামের একটি শাখা হলেও তা থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল এবং ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে এদের বসবাস। বিশ্বের প্রায় ১০ লক্ষ দ্রুজদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বসবাস করেন সিরিয়ায়, যেখানে তারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ।
ইসরায়েলে বসবাসরত দ্রুজ সম্প্রদায় মূলত রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত বলে বিবেচিত, কারণ তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে নিয়মিতভাবে সেবা দেয়। ইসরায়েল ও গোলান মালভূমিতে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ দ্রুজের বাস।
সিরিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্রুজরা বরাবরই একটি অনিশ্চিত অবস্থানে রয়েছে। গত ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে তারা স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব মিলিশিয়া গড়ে তোলে এবং মূলত দক্ষিণ সিরিয়ায় নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদের পতনের পর দ্রুজরা নতুন সরকারের প্রতি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে—কেউ কেউ সাবধানতা অবলম্বন করেছে, আবার কেউ সরাসরি বিরোধিতা করেছে। তারা সিরিয়ার নতুন সেনাবাহিনীতে একীভূত হওয়ার বদলে নিজেদের স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে চলেছে।
ইসরায়েলের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য
সাম্প্রতিক সংঘাতে ইসরায়েলের হস্তক্ষেপকে তারা ব্যাখ্যা করছে একটি "সতর্কবার্তা" হিসেবে—দক্ষিণ সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর অবস্থান তারা কোনোমতেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ইসরায়েল বিশেষ করে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত, যারা সিরিয়ার উত্তরের গোলান হাইটস সংলগ্ন এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠছে।
১৬ জুলাইয়ের ইসরায়েলি হামলাগুলি ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পরিচালিত বড় ধরনের সামরিক অভিযানের পর সবচেয়ে গুরুতর। ওই সময় ইসরায়েল একযোগে শত শত সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস করে এবং জাতিসংঘ-নিয়ন্ত্রিত একটি অঞ্চল দখল করে নেয়।
বর্তমানে ইসরায়েল নিজেদের উপস্থাপন করছে সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের ‘রক্ষক’ হিসেবে—কুর্দি, আলাউই এবং দ্রুজদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছে তারা। তবে অনেক দ্রুজ নেতা, বিশেষত সিরিয়া ও লেবাননের, ইসরায়েলকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাদের মতে, সংখ্যালঘুদের রক্ষার নামে ইসরায়েল আসলে অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়িয়ে নিজের আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
সিরিয়ার বর্তমান শাসক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
আসাদ সরকারের পতনের পর বর্তমানে দেশ শাসন করছেন আহমেদ আল-শারা—এক সময়ের ইসলামপন্থী জঙ্গি নেতা, যিনি ডিসেম্বরের বিদ্রোহে দামেস্ক দখল করে ক্ষমতায় আসেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন—সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই দ্রুজদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
এই ঘটনাগুলি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পথ এখনো অনেক দূরে। সাম্প্রতিক এই সংঘর্ষ ও বিদেশি হস্তক্ষেপ সিরিয়ার ভঙ্গুর নিরাপত্তা কাঠামোকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। শান্তি ফিরবে কি না, তা এখনই বলা কঠিন।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল