রবিন ঘোষ সশস্ত্র দল দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি তাদের বললেন, ‘আমার যা যা আছে সব তোমরা নিয়ে যাও। কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি কর না। আমার শিশুবাচ্চা ভয় পাবে!’ তাদের ছেলে রনি ঘোষের বয়স তখন সম্ভবত সাত আট বছর ছিল। কিন্তু রবিন ঘোষ-শবনম দম্পতি বুঝতে পারেননি দুষ্কৃতকারীদের আসল উদ্দেশ্য। তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে শবনমের ওপর...
‘আম্মাজান’-খ্যাত বাংলাদেশি অভিনেত্রী ও এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনম। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের সর্বকালের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ধরা হয় তাঁকে। ১৯৬০ সাল থেকে ’৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্র জগতে কাজ করেছেন তিনি। কেবল বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের ছবিতেও কাজ করেছেন শবনম। ৬০ এবং ৭০ এর দশকে নাদিম-শবনম এবং রহমান-শবনম জুটি মানেই সুপার ডুপার হিট সিনেমা ছিল। ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্র জীবনের শুরু এবং সারা জীবনে প্রায় ১৭০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন শবনম। মোট ১৩ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন শবনম। যে রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। কিন্তু এই তারকার জীবনের বীভৎস এক ঘটনা প্রকাশ্যে আসে।
১৯৭৮ সালের ১৩ মে সবচেয়ে আলোচিত হাই প্রোফাইলড ঘটনা ছিল বিখ্যাত এই নায়িকার গ্যাং রেপ। যা পাকিস্তান ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। লাহোরের পশ গুলবার্গ এলাকায় রবিন ঘোষ-শবনম দম্পতির বাড়িতে এক মর্মান্তিক অগ্নিপরীক্ষার শিকার হয়েছিলেন শবনম-রবিন ঘোষ দম্পতি। সাত অস্ত্রধারী শবনমের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। বাড়িতে ছিল কয়েকটি আলমিরা। যেখানে শবনমের মূল্যবান সব শাড়ি ড্রেস ছিল। রুপালি পর্দায় শবনমের পরনে যেসব ঝলমলে শাড়ি দেখা যেত, সেগুলো বস্তায় ঢুকিয়ে নেয় সাতজনের সশস্ত্র দল। তারপর বহুমূল্যের সোনার অলংকার লুটপাট করে। নগদ টাকাও নেয় তারা। বিখ্যাত সুরকার রবিন ঘোষ সশস্ত্র দল দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি তাদের বললেন, ‘আমার যা যা আছে সব তোমরা নিয়ে যাও। কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি কর না। আমার শিশু বাচ্চা ভয় পাবে!’ তাদের ছেলে রনি ঘোষের বয়স তখন সম্ভবত সাত আট বছর ছিল। কিন্তু রবিন ঘোষ-শবনম দম্পতি বুঝতেও পারেননি দুষ্কৃতকারীদের আসল উদ্দেশ্য। তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে শবনমের ওপর। তারা আসলে সেই উদ্দেশ্যেই রবিন ঘোষের বাড়িতে ঢুকেছিল। শবনমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাত জন্তু। তাদের নাম হলো মোহাম্মদ ফারুক বন্দিয়াল, ওয়াসিম ইয়াকুব বাট, জামিল আহমদ, তাহির তানভীর, জামশেদ আকবর সাহি, আগা আকিল আহমেদ এবং মোহাম্মদ মুজাফফর। সেদিন রবিন ঘোষ ও অবুঝ শিশু রনির সামনে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল লিজেন্ড শবনমকে। রবিন ঘোষ যিনি সুরের কারিগরিতে অদ্বিতীয় ছিলেন, সেদিন তাঁকে পৃথিবীর ‘সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি’ হয়েই থাকতে হয়েছিল। সেদিন কালজয়ী সুরের সেই মহান স্রষ্টা পারেননি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে রক্ষা করতে। ঘটনার পরে শবনম এবং তার পরিবারের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করা হয়, যাতে মামলা-মোকদ্দমা না করা হয়। কিন্তু সেই সময় চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাই শবনমের পাশে এসে দাঁড়ান। মোট সাতজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়। কিন্তু তাতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় শবনমকে। পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড, বাকি দুজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পায়। পরে ১৯৮৭ সাল থেকে শবনম লন্ডনকে তাঁর আবাসস্থল বানিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে উর্দু চলচ্চিত্র জগৎ থেকে অবসর নেন তিনি। ১৯৯৭ সালে ভয়ংকর বিভীষিকার স্মৃতি বুকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন শবনম।