গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। ২০ দফা সুপারিশের কিছু শক্তিশালী গণমাধ্যম গড়তে ভূমিকা রাখলেও অধিকাংশ সুপারিশ গণমাধ্যমের মৃত্যু ডেকে আনবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আশঙ্কা করা হচ্ছে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্ধেকের বেশি মূলধারার গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মৃত্যু ঘটবে ছোট গণমাধ্যমগুলোরও। এতে বেকার হয়ে পড়বে সারা দেশের লাখ লাখ গণমাধ্যমকর্মী, হকার, সংবাদপত্র এজেন্ট। নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমের ওপর এ আঘাত এলে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ নির্বাচন ও সরকারের উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারে মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, এ সুপারিশের মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে সংবাদপত্রের মৃত্যু চাইছেন তারা! সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এ কে আজাদ বলেছেন, আমরা তাদের গণমাধ্যমের সংকটগুলো বলেছিলাম। কিন্তু, তারা যে সুপারিশ দিয়েছেন তার অনেক কিছুই আমাদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। গত শনিবার প্রতিবেদন জমা দেয় সিনিয়র সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। প্রতিবেদনের সুপারিশে একক কোম্পানি/গোষ্ঠী/ব্যক্তি/পরিবার/উদ্যোক্তার মালিকানায় একটির বেশি গণমাধ্যম না রাখার ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়। কারও মালিকানায় একাধিক গণমাধ্যম থাকলে বাকিগুলো বিক্রি করে দেওয়া, একাধিক গণমাধ্যম একত্রিত করে একটি গণমাধ্যম করার সুপারিশ করা হয়েছে। কারও মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র থাকলে দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও সেটআপ দিয়ে হয় টেলিভিশন, না হয় সংবাদপত্র পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে। গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো হাউস কয়টা গণমাধ্যম চালু করতে পারবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো অকাট্য যুক্তি নেই। বৈধ টাকা দিয়ে গণমাধ্যমের মালিক হতে পারবে না কেন? আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সুর্নিদিষ্ট কিছু বিজনেস হাউসকে টার্গেট করে এ সুপারিশ আনা হয়েছে। ভারতে আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের অনেক পত্রিকা রয়েছে। ভারত সরকার তো কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেনি। তাই ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ চিন্তার পেছনে কোনো কূটকৌশল থাকতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’ ধারণা বাস্তবায়ন করা হলে দুই ডজনের বেশি মূলধারার গণমাধ্যম বিক্রি অথবা বন্ধ করে দিতে হবে। এতে সারা দেশে লাখ লাখ গণমাধ্যমকর্মী বেকার হবে। গোটা দুনিয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগে গণমাধ্যম শক্তিশালী হয়েছে। কর্মসংস্থান ও গণমাধ্যমকর্মীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে। এ খাতকে শিল্প হিসাবে সরকার ঘোষণা করলেও কমিশনের সুপারিশে এর কোনো প্রতিফলন নেই। উদ্যোক্তারা বলছেন, কারও মালিকানায় টেলিভিশন ও সংবাদপত্র থাকলে দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও সরঞ্জাম নিয়ে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম করার সুপারিশ করা হয়েছে। যারা এ সুপারিশ করেছেন, তারা ভালো করেই জানেন, এটা অসম্ভব। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের কর্মী, যন্ত্রপাতি, কাজের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা।
গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের সময় বেতন বিসিএস ক্যাডারদের স্কেলের সঙ্গে সংগতি রেখে দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। এতে মফস্বলের একজন সংবাদকর্মীকে বেতন দাঁড়াবে ৩৫ হাজারের বেশি। ঢাকার সাংবাদিকরা এর সঙ্গে পাবেন ‘ঢাকা ভাতা’। সংস্কার কমিশনের এ রিপোর্টকে ‘অবাস্তব’ উল্লেখ করে মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, এ সুপারিশের মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে সংবাদপত্রের মৃত্যু চাইছেন তারা! এমনিতেই সংবাদপত্রগুলো মৃত্যুর পথে। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই নেই। বিজ্ঞাপনের ৭০ ভাগ চলে যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। আয় না হলে মালিকরা সংবাদপত্র চালাবে কীভাবে? এই বেতন কীভাবে দেবে? এ ধরনের প্রস্তাবনা অলীক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। এতে অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাবে। নোয়াব সভাপতি ও দৈনিক সমকালের মালিক এ কে আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখন সংবাদপত্রের সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে। সেখানে তারা একজন সাংবাদিকের শুরুর বেতন সরকারি চাকরির নবম গ্রেডের সমান দিতে বলেছেন। এটা কি সম্ভব? আমাদের আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা মিডিয়াগুলো কীভাবে চালাব সেই পরামর্শও তারা দিক।
সংবাদপত্রকে ২০১৪ সালে শিল্প ঘোষণা করে সরকার। তবে শিল্প হিসেবে কখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি সংবাদপত্র। ডিজিটাল মাধ্যমের বিকাশে বিশ্বব্যাপী ছাপা পত্রিকা চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। রেডিও বিলুপ্তির পথে। ধুঁকছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বড় বড় মিডিয়া হাউসগুলো ছাঁটাই কাজ অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশে যে কয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের বেতন-ভাতা দিয়ে সত্যিকার অর্থে বাজারে টিকে আছে, তার পেছনে রয়েছে বড় বড় শিল্পপতিদের বিনিয়োগ। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ এসব গণমাধ্যমের মৃত্যু ডেকে আনবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।