শিল্পকলায় যে কয়েকটি মঞ্চ প্রোডাকশন চলছে সেগুলো মূলত শিল্পকলার নিজস্ব প্রযোজনা। সেটাও আবার ৮-১০ দিনের গ্যাপ দিয়ে। এর মধ্যে মাঝেমধ্যে বাইরের এক-দুটি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে। গত দুই মাস ধরে যেসব শিল্পকলার নিজস্ব প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে সেগুলো জুলাই অনুদানের। সেগুলো ছাড়া তেমন করে প্রযোজনা নেই শিল্পকলার মঞ্চে।
ঢাকার মঞ্চনাটকে বর্তমানে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বেশ কিছু কারণে নাটক মঞ্চায়ন কমে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, অভিভাবকহীন শিল্পকলা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নানামুখী আন্দোলন, নতুন নাটক মঞ্চায়নে অনাগ্রহ, পর্যাপ্ত মঞ্চের অভাব, মৌলিক পাণ্ডুলিপির অভাব, মিলনায়তন সংকট, হল বরাদ্দ নিয়ে জটিলতা, উৎসব স্থগিতসহ নানারকম সমস্যা। যদিও এখন কিছু নাট্যদল নতুন নাটক মঞ্চে আনার চেষ্টা করছে এবং কিছু পুরোনো নাটকও মঞ্চস্থ হচ্ছে। ধীরে ধীরে এ স্থবিরতা কাটানোর চেষ্টা চলছে। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্পকলায় যে কয়েকটি মঞ্চ প্রোডাকশন চলছে সেগুলো মূলত শিল্পকলার নিজস্ব প্রযোজনা। সেটাও আবার ৮-১০ দিনের গ্যাপ দিয়ে। এর মধ্যে মাঝেমধ্যে বাইরের এক-দুটি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে। আরও জানা গেছে, গত দুই মাস ধরে যেসব শিল্পকলায় নিজস্ব প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে সেগুলো জুলাই অনুদানের। সেগুলো ছাড়া তেমন করে প্রযোজনা নেই শিল্পকলার মঞ্চে। ফলে শিল্পকলার কর্মযজ্ঞ হয়ে পড়েছে স্থবির। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় ভাবা হচ্ছে শিল্পকলার মহাপরিচালক পদ শূন্যতা। সংস্কৃতি উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের অভিযোগসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলে সৈয়দ জামিল আহমেদ সেই যে মহাপরিচালকের পদ ছাড়লেন, তারপর থেকে যেন অভিভাবকহীন শিল্পকলা একাডেমি। এ সময়ে পরিষদের কোনো সভা শিল্পকলায় হয়নি। যদিও শিল্পকলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু শিল্পকলা চলছে মূলত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে। তাতে শিল্পকলার কর্মকাণ্ড হয়তো বন্ধ হয়ে যায়নি, কিন্তু স্থবিরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বর্তমান পরিষদের সদস্যসহ সংস্কৃতি ব্যক্তিবর্গ। ‘শিল্পকলার কাজের ব্যাপ্তি সারা দেশে। এরকম একটা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় মহাপরিচালকহীন থাকলে কাজ থেমে থাকবে’, বলছেন পরিষদের একজন সদস্য। এদিকে শিল্পকলা একাডেমির আইন অনুযায়ী পরিচালনা পরিষদ থেকে কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়ে আসার কথা। পরিষদই একাডেমির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সভা। কিন্তু মহাপরিচালক না থাকায় এখন শিল্পকলা কী করবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। একাডেমির কার্যাবলি পরিষদ সভায় অনুমোদিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু শিল্পকলার পরিচালনা পরিষদকে রাখা হয়েছে নিষ্ক্রিয় করে। প্রতি তিন মাস পর পর পরিষদের সভা করার নিয়ম থাকলেও জুলাইয়ের পট পরিবর্তনের পর পরিষদের সদস্য বদল হয়েছে এবং নতুন সদস্যদের নিয়ে সভা হয়েছে মাত্র একবার। শিল্পকলার পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের মতে, ‘সভা না হলে পরিষদের সদস্যদের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।’ এ প্রসঙ্গে শিল্পকলার বর্তমান পরিষদের সদস্য ও নাট্যজন আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘আমরা যারা পরিষদের সদস্য হিসেবে আছি, আমাদের তো কথা বলার জায়গা হলো পরিষদ সভা। সেই সভা না হলে তো আমাদের কথা বলার সুযোগও নাই। ফলে শিল্পকলার ব্যাপারে এখন আমরা খুব বেশি জানি না। আপনি যেমনটা দেখছেন, আমিও তা-ই দেখছি। আর সৈয়দ জামিল আহমেদ মহাপরিচালক থাকার সময় যে পরিষদ সভা হয়েছিল, সেখানে আমরা সারা দেশে কাজের ব্যাপারে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেগুলো তো এখন থেমে আছে। শিল্পকলার কাজের ব্যাপ্তি সারা দেশে। এরকম একটা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় মহাপরিচালকহীন থাকলে কাজ থেমে থাকবে। দ্রুত মহাপরিচালকে নিয়োগ দেওয়া উচিত এবং সেই সঙ্গে পরিষদের সভাও নিয়মিত হওয়া উচিত।’ পরিষদের আরেক সদস্য এবং মঞ্চ নির্দেশক সামিনা লুৎফা নিত্রা বলেন, ‘আমি পরিষদের সদস্য হওয়ার পর একটা মাত্র সভা হয়েছে। সেই সভায় আমরা কিছু পরিকল্পনা করেছিলাম। এরপর তো আর সভা হয়নি। পরবর্তী সভা হলে বুঝতে পারব আমাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কতদূর হয়েছে। আশা করছি পরের সভা দ্রুতই হবে। তবে কবে হবে, তা এখনো জানি না।’ থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ক্ষ্যাপার সম্পাদক পাভেল রহমান বলেন, ‘‘আইন অনুযায়ী শিল্পকলা একাডেমি একটি ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’। এর কাজের পরিধিও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু বহুদিন ধরেই শিল্পকলার পরিচালনা পরিষদকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। লিয়াকত আলী লাকী যখন মহাপরিচালক ছিলেন, তখনো তিনি পরিষদকে তোয়াক্কা করতেন না। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জামিল আহমেদ মহাপরিচালক হয়ে পরিচালনা পরিষদকে সক্রিয় করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি তাতে সফল হননি। মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে পদত্যাগ করেন জামিল আহমেদ। গত ৯ মাসে পরিষদের একটিই সভা হয়েছে। অথচ আইনে তিন মাস পর পর সভা করার কথা বলা আছে। জরুরি সভা করার সুযোগও আছে। কিন্তু জামিল আহমেদের পদত্যাগের মতো বড় ঘটনায়ও পরিষদের সভা করা হয়নি। এখনো নতুন মহাপরিচালক দেওয়া হয়নি। ফলে একাডেমি কার্যত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যেখানে শিল্পকলার পরিচালনা পরিষদকে সক্রিয় করার কথা, সেখানে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি এবং আইন অনুযায়ী সভা আহ্বানের দায়িত্বও তার ওপর ন্যস্ত। বিশেষ প্রয়োজনে অতিরিক্ত সভা ডাকার এখতিয়ারও তার রয়েছে। কিন্তু তিনি পরিষদের সভা করছেন না।’’ পাভেল আরও বলেন, ‘শিল্পকলার জাতীয় নাট্যশালা হলো নাটক মঞ্চায়নের সূতিকাগার। রাজধানীর ৮০টির বেশি নাট্যদল এখানে নাটক মঞ্চায়ন করে। বিভিন্ন জেলার নাট্যদলও এখানে নাটকের মঞ্চায়ন করে। শিল্পকলা নিজস্ব অনুষ্ঠানের নামে এই মিলনায়তন ব্যবহার করছে। আবার মিলনায়তন খালিও রাখা হচ্ছে। এতে নাট্যদলগুলোর নাটক মঞ্চায়নের সুযোগ পাচ্ছে না। বলা চলে মঞ্চায়ন সংকটের কারণে নাট্যচর্চায় স্থবিরতা নেমেছে। হয়তো পরিকল্পিতভাবেই নাট্যচর্চাকে গলা টিপে মারার মিশনে নেমেছে শিল্পকলা একাডেমি।’ এদিকে সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন লেখক-গবেষক আলতাফ পারভেজ। অন্যদিকে সৈয়দ জামিল আহমেদের পদত্যাগের চার মাসের মাথায় পদত্যাগ করেন শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক মোস্তফা জামান। সব মিলিয়ে একটা গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় থেকে স্থবির হয় এ অঙ্গন। এরপর থেকে মঞ্চেও নিভতে শুরু করে বাতি, জ্বলছে না এখনো তেমন করে আলো।