গ্লোবাল সাউথ তথা পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রায়শ অন্য কোনো দেশের নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। দেশগুলোর স্বাধীন-সার্বভৌম অস্তিত্ব সর্বস্বীকৃত হলেও রাজনীতি পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারে না বা হতে চায় না। আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, ভৌগোলিক আয়তন ও অবস্থান এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঐতিহাসিক কারণে তুলনামূলকভাবে ছোট দেশগুলোতে দানা পাকিয়ে ওঠে প্রক্সি পলিটিক্স। এই শ্রেণির রাজনীতিবিদরা কিছুটা জেনে, কিছুটা না জেনে অন্য কোনো দেশের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সহায়তা করে। ১৯৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার আগপর্যন্ত দ্বিমেরু বিশ্বে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল দুনিয়ার দেশগুলো। পাকিস্তান বরাবরই ছিল আমেরিকার ছাতার নিচে। ইন্ডিয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ না হলেও মস্কোর দিকে হেলেছিল। বাংলাদেশ পাকিস্তান আমলে আমেরিকানপন্থি, স্বাধীনতার পর মস্কোপন্থি ভায়া দিল্লি। পঁচাত্তর-পরবর্তী খোন্দকার মোশতাক আমলে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশের সরকার। তখন কিছু দিনের জন্য হলেও পাকিস্তানি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে তখন পাকিস্তানপন্থি চিন্তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে রাজনীতির এই বিপজ্জনক প্রবণতা অনেকটাই রূখে দেন। ভারত ও পাকিস্তান- উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এরূপ হলেও রাজনীতির মাঠে পন্থি রাজনীতি বা প্রক্সি পলিটিক্স ছিল।
নিজ দেশে বিদেশপন্থি রাজনীতির বিপদ কতটা ভয়ানক হতে পারে সমকালীন বিশ্বে তার বহু জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে মানবিক সংকট তীব্ররূপ পরিগ্রহ করেছে। গৃহযুদ্ধে ইয়েমেন বিভক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। ইউক্রেন পরিস্থিতি সম্পর্কেও কমবেশি ধারণা আমাদের রয়েছে। ১৯৯১ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও রাশিয়ার খবরদারি থেকে বের হতে পারেনি। রাশিয়া ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের মতো নেতা ও তাঁর অনুসারীদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত তথাকথিত গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেনের মানচিত্র থেকে ক্রিমিয়াকে ছেঁটে দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ইয়ানুকোভিচ ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর সরকার ইউক্রেনের জনগণের পরিবর্তে মস্কোর স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করেছিল। আর স্বশাসিত ক্রিমিয়ায় ছিলেন সের্গেই আকসেনভের মতো মস্কোর দালাল প্রক্সি পলিটিশিয়ানের দল। এরা তথাকথিত গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়াকে ক্রিমিয়া ভূখণ্ডটি উপহার দেওয়ার পক্ষপাতী ছিল। এরাই গোপনে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। সের্গেই আকসনভের রাজ্য সরকার ও রাশিয়ার সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত তথাকথিত গণভোটে দেখানো হয়েছিল, ক্রিমিয়ার ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোটার ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবং তারা রুশ ফেডারেশনে যোগ দেওয়ার পক্ষপাতী। ফলে ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সমাজ ক্রিমিয়ার এই গণভোটের বৈধতা স্বীকার করে না।
বস্তুত ইউক্রেনের আজকের যে সংকটজনক পরিস্থিতি তার মূলে রয়েছে প্রক্সি পলিটিক্সের অভিশাপ। মার্কিন-সোভিয়েত শীতল যুদ্ধের সময়কার তৃতীয় বিশ্ব তথা বর্তমান গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশের জনগণের ভাগ্য বিড়ম্বনার দায় পন্থি বা প্রক্সি পলিটিক্সের সর্বাধিক। এই ধারার রাজনীতি যারা করেন, তারা নিজের দেশকে অন্য কোনো দেশের ক্লায়েন্ট স্টেটে পরিণত করতে চায়। কখনো কখনো ক্রিমিয়ার নেতাদের মতো নগ্ন দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে এরা কুণ্ঠা বোধ করে না। এরা জনগণকে বিভ্রান্ত করে। সেটা করতে ব্যর্থ হলে বিভক্ত করে।
এই জায়গাটায় আফগানিস্তান প্রসঙ্গে খানিকটা আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয় মনে করি। আফগানিস্তানে সংকটের শুরু ১৯৭৮ সালে বহিঃশক্তি প্রভাবিত কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নূর মোহাম্মদ তারাকির ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আফগানিস্তানে এই বিপ্লবের নাম দেওয়া হয়েছিল সাউর (Saur revolution) বিপ্লব নামে। পশতু বর্ষপঞ্জিকায় সাউর একটি মাসের নাম, যেটা ইংরেজি মে মাসে এসে থাকে। সহজভাবে বললে সেটা ছিল মে বিপ্লব। সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় সমমনা দুটি দল। নূর মোহাম্মদ তারাকি ও হাফিজুল্লাহ আমিনের নেতৃত্বাধীন খালক্ব পার্টি ও বাবরাক কারমালের পরচম পার্টি। আফগানিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট দাউদ খানকে সপরিবার হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন নূর মোহাম্মদ তারাকি। তারাকির খালক্ব পার্টি ও বাবরাক কারমালের পরচম পার্টি মিলে গঠন করা হয় আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। যার ইংরেজি নাম দেওয়া হয়েছিল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিএ)। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় তারাকিকে হত্যা করে ক্ষমতা কেড়ে নেন তারই সহচর হাফিজুল্লাহ আমিন।
হাফিজুল্লাহ আমিনের ওপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল হয়ে আসার উপক্রম হলে দৃশ্যপটে আসেন বাবরাক কারমাল। তার আগেই সোভিয়েত সৈন্য আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। মস্কোর শতভাগ পুতুল বাবরাক কারমাল। তা সত্ত্বেও মিখাইল গর্বাচেভ মস্কোর ক্ষমতায় বসে বাবরাক কারমালকে সরিয়ে ১৯৮৬ সালে কাবুলের ক্ষমতায় বসায় ড. নজিবুল্লাহকে। এরই মধ্যে গর্বাচেভ শুরু করেন পেরোস্ত্রইকা (পুনর্গঠন) ও গ্লাসনস্ত (সংস্কার) কর্মসূচি। ফলে ড. নজিবুল্লাহর পুতুল সরকারের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। কাবুলে সোভিয়েত সাহায্য হ্রাস পায়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে তুলে নেওয়া হয়। ড. নজিবুল্লাহর পাপেট সরকার এতিম সরকারে রূপ লাভ করে।
সোভিয়েত আগ্রাসন ও কাবুলের ক্রীড়নক সরকারগুলোর সঙ্গে যুদ্ধরত তালেবান (ছাত্র) মুজাহিদরা খুব সহজেই কাবুল দখল করে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটার পরও নজিবুল্লাহ তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতা করে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারেননি। তালেবান মুজাহিদরা কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নিলে ড. নজিবুল্লাহ পালিয়ে জাতিসংঘ দপ্তরে আশ্রয় নেন। জাতিসংঘ দপ্তরের কম্পাউন্ডে তিনি ও তাঁর ভাই প্রায় চার বছর গৃহবন্দি ছিলেন। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৯৬ সালে মোল্লা ওমর তালেবান সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলে ২৭ সেপ্টেম্বর তালেবান বাহিনী জাতিসংঘ কম্পাউন্ডের ভিতর থেকে ড. নজিবুল্লাহ ও তাঁর ভাই আহমদকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করে। হত্যার পর শহরের মাঝখানে একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে ড. নজিবুল্লাহর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। তালেবানদের দাবি, সেটা ছিল গণ আদালতের বিচার। কিন্তু বিশ্বসমাজ এহেন তালেবানি বর্বরতা সমর্থন করেনি।
তালেবানরা ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তানের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করে। অভিযোগ রয়েছে, তালেবান সরকারের আশ্রয়ে থেকেই আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ট্রেড সেন্টার টুইন টাওয়ারে হামলা পরিচালনা করে। টুইন টাওয়ার ট্র্যাজেডি বদলে দেয় ভূরাজনীতির চালচিত্র। আবারও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে আফগানিস্তানের। পাশ্চাত্য জোট কাবুলে হামলা চালায়। কাবুলে মোল্লা ওমরের তালেবান সরকারের পতন ঘটে। মোল্লা ওমরের কী পরিণতি হয়েছিল, তা আজও জানা যায়নি। কাবুলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদেরই তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সে অনেক ইতিহাস।
অবশেষে মসনদে বসে আশরাফ ঘানির তথাকথিত নির্বাচিত সরকার। ২০২১ সালে আবার তালেবান। আমেরিকার পরোক্ষ সমর্থনে তালেবান বাহিনী পুনরায় কাবুল দখল করে নিল। পালিয়ে গেলেন আশরাফ ঘানি। স¥রণযোগ্য নব্বই দশকে তালেবান মুজাহিদরা সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ওয়াশিংটনের ভরপুর সাহায্য পেয়েছে। মোটকথা তালেবানের জন্মদাতা আমেরিকা। আমেরিকাই তাদের ধ্বংস করেছিল। আবার এই আমেরিকাই তালেবানকে ফিরিয়ে এনেছে। মাঝখান থেকে ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছে কিছুসংখ্যক প্রক্সি পলিটিশিয়ানের, যারা আফগানিস্তানকে বানিয়েছিল, কখনো আমেরিকার, কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্লায়েন্ট স্টেট। কাবুলে প্রতিষ্ঠা করেছিল আমেরিকা কিংবা সোভিয়েতের পুতুল সরকার।
প্রক্সি পলিটিক্স শেষ বিচারে কখনো কোনো জাতির ভালো করতে পারে না। এই শ্রেণির রাজনীতিবিদের হাতে পড়ে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল কত দেশে যে অশান্তির আগুন জ্বলছে তার ইয়ত্তা নেই। এরা সব সময় মুখে বড় বড় কথা বলে। হাজির করে নানান তত্ত্ব। নতুন নতুন কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। রুদ্ধ করে দেয় জাতীয় ঐক্য ও অগ্রসরতার পথ। এদের বিষয়ে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, অবলম্বন করা দরকার সর্বোচ্চ সতর্কতা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক