শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির বিস্তীর্ণ অঙ্গনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এমন এক আলোকবর্তিকা, যাঁর নাম উচ্চারণেই জ্বলে ওঠে এক নৈতিক ও মননশীল দীপ্তি। আমাদের জাগতিক জীবনে তাঁর মৃত্যু কেবল এক প্রতিভাবান শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক বা চিন্তাবিদের প্রয়াণ নয়; এ যেন এক প্রজ্ঞাময় যুগের অবসান। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই এমন এক অধ্যাপক, যিনি পাণ্ডিত্যকে সীমাবদ্ধ রাখেননি পাঠ্যবইয়ের পাতায়। ফলে তাঁর প্রতিটি ক্লাসরুম ছিল এক মুক্তচিন্তার কর্মশালা, যেখানে জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হতো মানবিকতা, নৈতিক বোধ ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা। তাঁর পাঠ ছিল একধরনের শ্রেয়চেতনার আলোকিত সাধনা-যেখানে শিক্ষার্থী কেবল তথ্য অর্জন করত না, বরং আত্মসচেতনতা, মানবিক বোধ ও স্বাধীন চিন্তার প্রশিক্ষণ লাভ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যেও তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তার অনুশীলক ও অভিভাবক, যিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন জ্ঞান মানে শুধু তথ্য কিংবা তত্ত্ব মুখস্থ করা নয়, বরং প্রশ্ন তোলা, যুক্তি নির্মাণ ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। এই গুণেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশের বৌদ্ধিক পরিসরে হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য উপস্থিতি; ভদ্রতা ও নম্রতায় হৃদ্য প্রজ্ঞা, সততা ও মানবিকতার এক দীপ্ত প্রতীক।
শ্রেণিকক্ষে কিংবা যে কোনো বক্তৃতার মঞ্চে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উপস্থিতি ছিল যেন এক বৌদ্ধিক উদ্যাপন। তাঁর শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা ছিল কেবল পাঠ নয়; ছিল শিক্ষার্থী বা অংশগ্রহণকারীদের জন্য চিন্তার জাগরণ, নৈতিকতার অনুশীলন, আর মানবিকতার প্রশিক্ষণ। শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হতো তাঁর কণ্ঠে, তাঁর শব্দচয়ন ও ব্যাখ্যার গভীরতায়; প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি যেন সত্য, সৌন্দর্য ও কল্যাণের এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটাতেন। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষক, যিনি কেবল জ্ঞানের সরবরাহকারী নন, বরং শ্রেয়চেতনার প্রেরণাদাতা হিসেবে যিনি শিখিয়েছেন সততা, যুক্তিবোধ এবং সহমর্মিতার মর্মার্থ। তাঁর পাঠদানে বিশ্বসাহিত্যের চরিত্ররা যেমন জীবন্ত হয়ে উঠত, তেমনি সমাজ, রাজনীতি ও নৈতিকতার জটিল প্রশ্নও আলোচিত হতো গভীর দার্শনিক ও নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি ছিলেন এমন এক শিক্ষক, যিনি জ্ঞানকে কেবল বৌদ্ধিক অর্জন নয়, বরং আত্মার বিকাশ হিসেবে দেখতেন। এক অর্থে, তাঁর শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছিল সক্রেটিসের ‘ডায়ালগ’-এর আধুনিক প্রতিরূপ, যেখানে প্রশ্ন ছিল জ্ঞানের সূচনা, আর আলোচনাই ছিল মানবতার পথে যাত্রার আয়োজন।
১৯৯৫ সালের দিকে ইংরেজি শেখার একটি বিশেষ কোর্সে তাঁকে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসেবে। তাঁর সরাসরি ছাত্র হওয়ার যে সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, সেটিই ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এ কোর্সে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক নয়, সমকালীন চিন্তাচেতনার তুলনায় প্রাগ্রসর একজন গভীর মানবিক চেতনার চিন্তাবিদকে জানার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। অল্প কয়েকটি পাঠেই বুঝে গিয়েছিলাম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জ্ঞানকে কখনো শিক্ষকতার পেশায় কিংবা শ্রেণিকক্ষের পরিসীমায় বন্দি রাখেননি; তিনি তাকে জীবনের এক নৈতিক অনুশাসন, এক মানবিক সাধনা হিসেবে ধারণ করেছিলেন। তাঁর শ্রেণিকক্ষের বাইরে, তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে একান্ত সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা আমার মনে এক গভীর ও স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনার পাশাপাশি সমকালীন শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর গভীর বিশ্লেষণ দেখিয়েছে যে কীভাবে একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিটি পরিবর্তনকে আত্মস্থ করেন, তা নিয়ে ভাবেন এবং তার নৈতিক তাৎপর্য অনুসন্ধান করেন।
তাঁর কক্ষে বসে কথা বলার অভিজ্ঞতা ছিল যেন এক উন্মুক্ত জ্ঞানের জগতে প্রবেশের মতো, যেখানে অহংকার, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মানসিক প্রতিরোধের কোনো স্থান নেই। সেখানে শুধু ছিল জ্ঞানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, শিক্ষার্থীর প্রতি আন্তরিক মমতা এবং চিন্তার অনন্ত দিগন্তে অবারিত আহ্বান। তিনি প্রতিটি আলাপচারিতাকে একধরনের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে দেখতেন যেখানে প্রশ্ন তোলা, মতামত শোনা এবং ভাবনার নতুন দিক উন্মোচন করা ছিল পাঠের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর এই সংলাপমুখী পদ্ধতিই শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তাদের ভিতরে নিহিত সম্ভাবনার আলোকে জাগ্রত করে। সে কক্ষে বসে বোঝা যেত সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন যে প্রতিটি শিক্ষার্থী এক সম্ভাবনাময় সত্তা এবং তাঁর দায়িত্ব হলো সেই সম্ভাবনাকে আবিষ্কারের মাধ্যমে আলোকিত করা। তাঁর বিনয়, মানবিকতা ও বিনিময়ভিত্তিক শিক্ষাদর্শন শিক্ষার্থীর মননশীলতার আকাশকে প্রসারিত করত এবং জ্ঞানকে কেবল তথ্যের সঞ্চয় নয়, বরং জীবনচর্চার এক শিল্প হিসেবে উপলব্ধি করাত। সেই থেকে আমার কাছে তিনি রয়ে গেছেন এক কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাগুরুর প্রতীক; একজন বিনয়ী, আন্তরিক ও আলোকিত শিক্ষক হিসেবে যিনি কেবল আমাদের ইংরেজি ভাষাই শেখাতেন না, বরং দিতেন জীবনকে বোঝার ও উপলব্ধি করার নিত্যনতুন সূত্র। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে সমাজবীক্ষণের সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও নৈতিক চেতনার পরিশীলন, তেমনি তাঁর শিক্ষকতাও ছিল গভীর মানবিক মূল্যবোধে আবিষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সাহিত্য কেবল কল্পনার রূপ বা ভাষার কারুকাজ নয়; এটি মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করার এক নৈতিক অনুশীলন, যা পাঠককে করে তোলে সংবেদনশীল, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় এবং মানবিকতার পথে দায়বদ্ধ। তাই সাহিত্যের পাঠে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতেন শুধু কাহিনির কাঠামো বা চরিত্র বিশ্লেষণে নয়, বরং পাঠের অন্তর্নিহিত নৈতিক তাৎপর্য অনুধাবনে। আর সে কারণেই শিক্ষার্থীদের মতে, তাঁর শ্রেণিকক্ষে সাহিত্য হয়ে উঠত এক আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে তারা আবিষ্কার করত জীবনের জটিল সত্য, সামাজিক বৈষম্যের নির্মমতা এবং নৈতিক দায়িত্বের মর্মবেদনা। তাঁর মতে, ‘ভালো সাহিত্য আমাদের শেখায় আমরা মানুষ এবং এই মানুষ হওয়াটাই এক অনন্ত সাধনা।’ এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে প্রথাগত পণ্ডিত বা শিক্ষকের সীমা অতিক্রম করে এক জীবনদ্রষ্টা গুরুর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর সাহিত্যচর্চা ও শিক্ষকতা পরস্পরকে পরিপূর্ণ করেছে যাতে একদিকে ছিল চিন্তার স্বাধীনতা, অন্যদিকে ছিল নৈতিক বোধের শুদ্ধতা। তাই তিনি কেবল ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন না; তিনি ছিলেন জীবনপাঠেরও এক উজ্জ্বল দিশারি। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই সমান স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এক বিরল দ্বিভাষিক সৃষ্টিশীল মননের অধিকারী। তাই তাঁর অনুবাদে বিশ্বসাহিত্যের রচনাগুলো যেন নতুন প্রাণ পেত। তাঁর হাতে ভাষা হয়ে উঠত কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ভাব ও অনুভূতির সেতুবন্ধন। তাঁর অনুবাদে পাঠক আবিষ্কার করত এক অভূতপূর্ব সামঞ্জস্য তথা ভাষার সৌন্দর্য, চিন্তার গভীরতা এবং নৈতিক সংবেদনশীলতার অনবদ্য মেলবন্ধন। তিনি অনুবাদকে কেবল কারিগরি প্রয়াস হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন এক মানবিক দায়িত্ব হিসেবে, যার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার চেতনা পৌঁছে যায় আমাদের সংস্কৃতির ভিতরেও। তাঁর এই আন্তঃসাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সমকালীন তরুণ লেখকদের। তাঁর লেখার শৈলী, ভাবনার প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অনেক নবীন সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচকের কাছে হয়ে উঠেছে একধরনের দিকনির্দেশনা। তাঁরা দেখেছেন, কীভাবে সাহিত্য ও শিল্প হতে পারে নৈতিক অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্র, কীভাবে অনুবাদ হতে পারে এক সাংস্কৃতিক সংলাপের প্রক্রিয়া। এভাবেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল একজন অনুবাদক, সাহিত্যিক কিংবা সমালোচক নন, বরং এক সেতুবন্ধন নির্মাতা হিসেবে যিনি ভাষা ও সংস্কৃতির সীমা অতিক্রম করে মানবতার অভিন্ন সুরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
তাঁর সহকর্মী, ছাত্রছাত্রীরাসহ শুভানুধ্যায়ীরা যেভাবে স্মরণ করেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে, তাতে প্রতিফলিত হয় এক মানবিক চরিত্রের বিরল স্বচ্ছতা-অসাধারণ বিনয়, কঠোর নৈতিকতা, সততার প্রতি অটল বিশ্বাস এবং জ্ঞানের প্রতি আজীবন নিষ্ঠা। এই গুণগুলোই তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল এমন একসময়ে যখন জ্ঞান অনেকাংশে পেশাগত প্রতিযোগিতা, সাফল্যের মাপকাঠি বা আত্মপ্রদর্শনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। তিনি নিবৃতচারী ও নিরহংকারী চারিত্রিক স্বভাবে এসব প্রবণতার বাইরে অবস্থান করে জ্ঞানচর্চাকে দেখেছেন মানবমুক্তির এক নিরন্তর যাত্রা হিসেবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে জ্ঞান ছিল না ক্ষমতা অর্জনের উপকরণ, বরং আত্মশুদ্ধি ও সামষ্টিক কল্যাণে সামাজিক ন্যায়ের পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান যদি মানুষকে বিনয়ী না করে, তবে তা কেবল বুদ্ধির খেলা- আলো নয়, অন্ধকারেরই আরেক রূপ। তিনি এখন আর শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে বেঁচে নেই; কিন্তু তাঁর লেখনী, শ্রেণিকক্ষের স্মৃতি, উচ্চারণের মায়াময় ধ্বনি, হাস্যোজ্জ্বল মুখ তাঁর অগণিত শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বাকি জীবনও জীবন্ত, স্পন্দমান থাকবে। তাঁর ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্য, তাঁর ধরিয়ে দেওয়া প্রতিটি চিন্তাসূত্র শিক্ষার্থীদের জীবনে তাঁর উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। তাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এবং থাকবেন এক মননশীলতার বাতিঘর হয়ে। তিনি দেখিয়েছেন একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, বরং শিক্ষার্থীর ভিতরে জ্ঞানের আলো জ্বালান; এমন এক আলো, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অতিক্রম করে জ্ঞান বিকাশ ও বিস্তারের ছিলছিলায় মানবতার দিকনির্দেশনা হয়ে থাকে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়; এটি এক নৈতিক দায় ও প্রতিশ্রুতি, এক মানবিক অঙ্গীকার। তাঁর কর্মময় জীবনের উদাহরণগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একজন শিক্ষক যদি সত্যনিষ্ঠা, যুক্তিবোধ ও সহমর্মিতায় দৃঢ় থাকেন, তবে তিনি শুধু তাঁর শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো জাতিকেও আলোকিত করতে পারেন। সেই অর্থে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল একজন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক কিংবা অনুবাদকই নন, তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য চেতনার স্থপতি যিনি অবক্ষয়ের চোরাবালিতেও আলো জ্বেলে গেছেন নীরবে, সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামীর অবিচল বিশ্বাসে। আর তাঁর উত্তরসূরিদের দায় এখন সেই আলোকে বয়ে বেড়ানো, আর সেই আলোয় জাতিকে আলোকিত করে তোলার।
লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য