অধিকারের পক্ষে আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে যাঁরা কণ্ঠ ও কলম চালানোয় নিরলস, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হওয়া মানবীয় কর্তব্য। ওই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে বিপদাপন্ন হন টেলিফোন বিভাগের সাধারণ কর্মকর্তা মুনশি ফারুকুল আলম। হৃদরোগের তীক্ষ্ণ ছোবলে পর্যুদস্ত হয়ে তিনি মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে দুনিয়া ত্যাগ করেছিলেন। স্কুলজীবনের যেসব সহপাঠীর স্মৃতি বিশেষ বিশেষ সময়ে আমায় কাবু করে ফেলে তাদের অন্যতম এই মুনশি ফারুক।
বিস্তর গুণ ছিল তাঁর। নাটকে অভিনয় করতেন দারুণ, গাইতেন চমৎকার। সদাচারী ও বিনয়ী হিসেবে নাম করেছিলেন। পরোপকার করতে মুখিয়ে থাকতেন যেন। ছিলেন বন্ধুকৃত্যে নিবেদিতপ্রাণ। পুলিশ লাইনসের পুকুরে পুলিশ কর্মকর্তাদের ছেলেরা এবং পার্শ্ববর্তী মহল্লার ছেলেরা গোসল-সাঁতারের অধিকার ভোগ করছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পূর্বাপর। আরআই (রিজার্ভড ফোর্সেস ইন্সপেক্টর) পদধারী ছিলেন পুলিশ লাইনসের নিয়ন্ত্রক। ১৯৬০ সালে ভিন্ন জেলা থেকে বদলি হয়ে আসা নতুন আরআই ফরমান জারি করলেন- ‘পানিদূষণ বন্ধের উদ্দেশ্যে বহিরাগতদের এই পুকুর ব্যবহারের অধিকার রদ করা হলো।’
টিপু নামে এক কিশোরের বাবা মজিরউদ্দিনের নেতৃত্বে অ-পুলিশ পিতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বললেন, ‘আরআইর ফরমান বেইনসাফির ফরমান। এটা মানি না, মানব না।’ তাঁরা এক দুপুরে পুকুরের চারপাশের রাস্তায় চক্কর দিয়ে মিছিল করলেন। বক্তৃতা দিলেন, এই ফুস্কুন্নি ঐতিহ্যবাহী ফুস্কুন্নি। এইখানে এতদিন যেই সিস্টামে আংগো পোলাপাইন গোসল কইচ্ছে, হাঁছুর (সাঁতার) দিছে, সেই অধিকারতুন কেউই আংগোরে বঞ্চিত করতে পারবে না।
‘পারবে না/পারবে না’ আওয়াজ জোরদার হয়ে উঠল। ওঠাই স্বাভাবিক। কেননা পুকুরটির অপুলিশজাত সাঁতারুরাও মিছিলে শামিল হয়েছিল। তাদের সঙ্গে এসেছিলেন মুনশি ফারুক। আমরা বললাম, তুই তো এখনো বিয়ে করিসনি। তোর পোলা সংক্ষুব্ধদের একজন হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তুই পোলাপানের সঙ্গে ওখানে গেলি কেন?
জবাবে মুনশি ফারুক বলেন, বৈষম্যবিরোধী হওয়ার জন্য কৃতদার হতে হবে, এমন আইন তো জারি হয়নি। বিবাহিত বা অবিবাহিত, যে কোনো অবস্থায় বিবেকটা সাফ রাখা চাই। ওটা সাফ থাকলে কালোকে কালো আর ধলোকে ধলো বলা কোনো সমস্যা না। পানি দূষিত হওয়ার ভয়ে পুকুরে গোসল-সাঁতার নিষিদ্ধ করেছ অথচ তোমাকে যে ‘জিন্দাবাদ’ যে দেব সে পথ খোলা রাখলে না। পুলিশের পোলাপানরা তো ওই জলাশয়ে মজাসে ঝাঁপাচ্ছে।
পুলিশ লাইনসে শান্তিভঙ্গের একটা মামলা হয়েছিল। তাতে সরলমনা কিশোরদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় মুনশি ফারুকের বিরেুদ্ধে। তাঁকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানাও জারি হয়ে যায়। বন্ধুরা তাঁকে গা-ঢাকা দিতে বললে তিনি বলেন, ও নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। গ্রেপ্তার হওয়ার অধিকার যেমন আমার, গ্রেপ্তার এড়িয়ে যাওয়ার অধিকারও আমার।
২.
গোসল-সাঁতার নিষিদ্ধকরণ ঘটনাজনিত মামলায় ধরপাকড় পর্যায়ে বাড়িতে পুলিশ এলো। মুনশি ফারুক ধরা দিতে আইনি লড়াই করতে প্রস্তুত। দরজার কড়া নাড়লেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর (এএসআই) আফতাব উদ্দিন। মুনশি ফারুক দরজা খুলতেই চমকে ওঠেন তিনি : ইয়া আল্লাহ! কারে গ্রেপ্তার করতে এলাম! এ যে আমার বাল্যসখা ফারুক!
এএসআই আফতাব এবং ফারুক, দুজনের পিতাই সরকারি চাকুরে। ময়মনসিংহ জেলা শহরে চাকরিকালে তাঁরা একই মহল্লায় বাস করতেন। আফতাব ও ফারুক একই স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়তেন। দুজন একই সংগীতগুরুর শিষ্য। এখন অনেক বছর পরে দেখলেও, ফারুককে দেখেই চিনে ফেলেছেন আফতাব। সুরে সুরে বলেন, ‘বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল সে কি আমারই পানে ভুলে পড়িবে না...।’ ফারুক বলেন, এটা কি গান গাওয়ার জায়গা? আফতাব বলেন, হাওয়া খাওয়ার জায়গাও না। আয়, তোরে একটু লাইতথাই।
‘এই তুই বরিশাইল্লা আফতাইব্বা না?’ বলতে বলতে কোলাকুলি করেন ফারুক। আসামি ধরতে এসে আসামির মা-বাবাকে কদমবুচি করে এএসআইর প্রস্থান। শেষতক আফতাব উদ্দিনের হস্তক্ষেপে বাদী-বিবাদী রফা হলো। পুলিশপুত্রদের জন্যও নিষেধাজ্ঞা দেন আরআই, প্রত্যাহার করেন মামলা। কালক্রমে আফতাব উদ্দিনের সঙ্গে আমারও হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। প্রাণের গভীর থেকে বাণী উজাড় করে গাইতেন তিনি। সব ধরনের গান জানতেন। অনুরোধ করলে খালি গলায় গাইতেও কুণ্ঠা ছিল না তাঁর। রবীন্দ্রনাথ বা রবিঠাকুর বলতেন না। দু’তিনটি গান শোনানোর পর শ্রোতাদের সম্মতির অনুমতির আশায় বলতেন, এখন রবিবাবুর একখানা গান গাই? আফতাবের মধ্যে অধিকারমনস্কতা দেখেছি। আমাদের শহরের ‘ফাল্গুনী’ সাংস্কৃতিক সংস্থার সভাপতি গীতিকার কে জি মোস্তফা, মানে খোন্দকার গোলাম মোস্তফা (মৃত্যু : ৯ মে, ২০২২/৮৪ বছর বয়সে ঢাকায়) খুব পছন্দ করতেন আফতাবের গায়কি। ফাল্গুনী একবার মঞ্চস্থ করে ‘বারো ঘণ্টা’ নামের নাটক। এ সংস্থায় সংশ্লিষ্ট থাকায় দেখতে পাই, নাটকের একটা চরিত্র অমলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ আফতাব। তাঁর সাফ কথা : ক্যারেক্টারটা মোর পছন্দ হইয়া গেছে। এইয়া আমারে করতে দেতে অইবে।
‘তোমার জন্য এটা মানানসই নয়।’ বলেন, কে জি মোস্তফা, ‘তুমি, অন্য ক্যারেক্টার নাও। অমলের রোল করবে সৈয়দ মাসুদুর রহমান।’ আফতাব বলেন, সৈয়দ মাসুদ মানে সেন্টু ভাই? জবাবে মাথা নাড়েন ‘ফাল্গুনী’র সভাপতি। আফতাব বলেন, খাড়া নাক, টল ফিগার হাসলে সুন্দর সুন্দর দাঁত কেলাইয়া উডে। তার উপরে সেন্টু ভাই হইলেন লোকাল। চমৎকার চমৎকার সব ক্যারেক্টারই তো লোকালগোরে দিয়া ফালাইছেন। মোরা যারা পরবাসী এমিগ্রান্ট, মোদের জন্য রাইখা দিছেন ফালতু ফালতু ক্যারেক্টার। হোয়াই?
‘ফাল্গুনী’ সংস্থার সর্বজনমান্য মুরুব্বি কাজী মাহফুজুল হক বলেন, ‘গভর্নমেন্ট অফিসার হয়ে এভাবে স্থানীয়-প্রবাসী বিভক্তি করছ তুমি! এ ভারি অন্যায় আফতাব।’
‘বিভক্তি নয় কাকা! এটা অধিকারের প্রশ্ন।’ বলেন, আফতাব উদ্দিন, ‘নাটকের ইম্পটেন্ট রোল করবার অধিকার নন-লোকালদেরও আছে। আমি সেন্টু ভাইয়ের মতো টল্ না, উনার গায়ের রং ফর্সা, আমার শ্যামলা, আমার নাক ভোঁতা। সেজন্য অমলের চরিত্র করার অধিকার থাকবে না? আমার ভোঁতা নাক আমি বানাইছি? আমার হাইট, আমার বডি কালার এগুলান কি আমার হাতে তৈরি?’
৩.
খান আতা পরিচালিত ছায়াছবি ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’ ১৯৬৯ সালে দেখানো হয় আমার জেলা শহরের সিনেমা হলে। নাম ভূমিকায় আনোয়ার হোসেনের অভিনয় দেখে দর্শকরা অনেকেই কেঁদেছেন। অনেকেই দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। আমি আর আমার বন্ধু মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, সৈয়দ দেলোয়ার, করিম মিন্টু, শাহ আকবর, সুলতানুল আলম- আমরা ফিল্মটি আটবার দেখেছিলাম। তবু আশ মেটেনি। এসব লিখতে গিয়ে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। আমার পাঁচ বাল্যবন্ধুর সবাই এখন ঘাসের নিচে শুয়ে রয়েছেন।
একবার রাত ৯টার শোয়ে ‘সিরাজদ্দৌলা’ দেখছি আমরা ছয়জন। প্রদর্শন শুরুর প্রায় পনেরো মিনিট পরে হলে ঢুকলেন আইজুদ্দিন জোতদার। তাঁর সহচর চার ব্যক্তি সমস্বরে চিৎকার করছেন, ‘শো বন্ কর/বন্ কর। আবার এক্কেবারে হইলাত তুন (শুরু থেকে ফের) দেখাও।’ গেটকিপার এসে অনুনয় করে, ভাই ভাই। দয়া করে বইসা পড়েন। সহচর চতুষ্টয় বলেন, তোমগো বাদাইম্মা ম্যানেজাররে বোলাও।
ম্যানেজার ছুটে এলেন। তাঁকে জোতদার আইজুদ্দিন বলেন, শুরুত তুন দেখার ব্যবস্থা করেন। ম্যানেজার বলেন, তা তো সম্ভব না। প্রায় বিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। এখন পয়লা থেকে দেখানো শুরু করলে দর্শকরা বিরক্ত হবে। আইজুদ্দিন বলেন, আল্লায় এক্খান মাথা দিছে। মাথাডা কাজে লাগান। আমরা এতক্ষণ ধইরা চিক্কর দিতেছি। একজন দর্শকও কী আংগোরে চুপ যাইতে কইছে?
চুপ করতে বলবেই বা কেন। ফের প্রথম থেকে মাগনায় শো দেখবার সুযোগ হাতছাড়া করার পক্ষপাতী তারা নয়। ম্যানেজার বলেন, গায়ের জোরে শুরু থেকে আবার দেখবেন? আইজুদ্দিন বলেন, গায়ের জোর দেখানোর অধিকার কি খালি মেজিস্টর (ম্যাজিস্ট্রেট) হাদী মিয়ার? রবিবার দিন হ্যাতেন হলে ঢুইকছেন ছবি শুরুর ঘণ্টা খানেক পরে। উনার হুকুমে সেই দিন এক্কেরে হইলাত তুন ছবি দেখাইছেন। হুকুম চালাইবার অধিকার আমারও আছে। চার সহচর বলে, জে আছে। অবশ্যই আছে।
৪.
খাওয়ার যত রকম অধিকার তার মধ্যে বেশি উপাদেয় ডিগবাজি খাওয়ার অধিকার। এ কথা বলে গেছেন নাট্যকার নূরুল মোমেন (জন্ম : ২৫ নভেম্বর ১৯০৮। মৃত্যু : ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০)। সম্ভবত এ কারণেই কোনো কোনো রাজনীতিক ডিগবাজি খেয়ে সংবাদ শিরোনাম হন।
১৯৭২-৭৩ সালে একটি রাজনৈতিক দলের মগডালে বসা এক নেতা প্রায়শ হুমকি দিয়ে সরকারপ্রধানের উদ্দেশে বলতেন, ক্ষমতা ছাড়। নইলে তোমার পিঠের চামড়া তুলে নিয়ে সেই চামড়ায় জুতো বানাব।
যাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে বলা হয়েছিল তিনি ক্ষমতা ছাড়েননি। হুমকিদাতাও হুমকি কার্যকর করেননি। মাঝখানে তেইশ বছর পার। আমরা দেখলাম, পিঠের চামড়া তুলতে বদ্ধপরিকর নেতা, পিঠের চামড়া যার তুলে নিয়ে জুতো বানাতে চেয়েছিলেন তাঁরই সন্তানের অতি বিশ্বাসভাজন হিসেবে পুরস্কৃত এবং ক্ষমতায়িত।
নেতার সমালোচকরা বলেন, বাপের চামড়ায় জুতো বানাব বলব, আর সেই বাপের সন্তানের জুতোয় সজ্ঞানে সাড়ম্বরে ঢুকে পড়ব, এ কেমন ধারার ডিগবাজি!
‘এরা শুধু ডিগবাজি ডিগবাজি করছে।’ বলেছেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক আফলাতুন (মৃত্যু : ১৪ মে, ২০০৬) ‘এরা একটুও বিবেচনায় নিচ্ছে না যে জুতোয় ঢুকে পড়ার অধিকার বলেও একটা ব্যাপার আছে। বুদ্ধিমানরা ওই অধিকারের উপযুক্ত মূল্যদানে প্রস্তুত।’
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন