২০২৪ সালের জুলাইয়ের সেই উত্তাল দিনগুলোতে গণ আন্দোলন ত্বরান্বিত করেছিলেন আমার মতো সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। মিরপুর ডিওএইচএস থেকে বের হয়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে অগণিত ছাত্র-জনতার একটি মিছিল নিয়ে গণভবন অভিমুখে যাত্রা করি। একইভাবে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসারস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনর (রাওয়া) সদস্যরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে মহাখালীতে অবস্থান নেন। নাটকীয় মোড় নেয় আন্দোলন, স্বৈরাচারী শাসকের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশীজন হিসেবে আজ কিছু কথা না বললেই নয়।
গণ আন্দোলন দমনে বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে-নির্যাতনে নিহত সব শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলছি, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের অবশ্যই বিচার হতে হবে। তবে বিচারের দাবি যেন অবিচারের পরিবেশ তৈরি না করে, এ ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক হতে হবে। একজন সাবেক বিজিবি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমি কিছু প্রচলিত ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করতে চাই। প্রথমে ডেইলি স্টার, এরপর নেত্রনিউজ জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট দিল- গণ আন্দোলন দমনে বিজিবির গুলিতে সারা দেশে ৮০ জন নিহত হয়েছে। কার গুলিতে কে মৃত্যুবরণ করেছে, এটা প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। আদালতের রায় এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত। তবে চলমান মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই বিজিবির গুলিতে নিহতের যে সংখ্যা দেওয়া হলো, তা অতিরঞ্জিত বলে প্রতীয়মান। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নসাপেক্ষও! বর্তমানের মিডিয়ার আধিক্য ও প্রযুক্তির যুগে যেখানে পুলিশের এপিসি থেকে মৃতদেহ ফেলে দেওয়া, পোড়ানো মৃতদেহ গাড়িতে তোলা ইত্যাদি অসংখ্য ভিডিও কিংবা স্থিরচিত্র রয়েছে সে ক্ষেত্রে বিজিবি কর্তৃক (দুই-একজন বিজিবি সদস্য কর্তৃক গুলি করার দৃশ্য ছাড়া) এ ধরনের কোনো ভিডিও কিংবা ছবি কোথাও দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্যকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই কেননা যে দোষী তার শাস্তি পাওয়া উচিত; তবে সেজন্য একটি স্বনামধন্য বাহিনীকে মৃত্যুর অতিরঞ্জিত সংখ্যার মাধ্যমে ট্যাগ লাগানো সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রামপুরা-বনশ্রীর ঘটনাকে ঘিরে সম্প্রতি জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স (জে আর এ) দাবি করেছে, নিহত ৯৪ জনের মধ্যে ৬৬ জন বিজিবির গুলিতে শহীদ হয়েছে; এ পরিসংখ্যান এখনো কোনো স্বতন্ত্র উৎসে যাচাইযোগ্য হয়নি। প্রকাশ্য নথি, স্বাধীন অনুসন্ধান, গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে কোনো নির্ভরযোগ্য মিল পাওয়া যায়নি। অতএব এ সংখ্যাতত্ত্বকে চূড়ান্ত পরিসংখ্যানের বদলে অভিযোগ হিসেবে দেখা উচিত এবং অভিযোগের স্বচ্ছ ও প্রাতিষ্ঠানিক যাচাই অপরিহার্য। বিজিবি জনগণের বাহিনী। গ্রামবাংলার মাটির সন্তানরাই এই বাহিনীর মূল শক্তি। জুলাই আন্দোলনে তদানীন্তন সরকারের আদেশে মোতায়েন হয়েছে। তবে কার্যক্ষেত্রে বিবেক দিয়ে পালন করেছে যেন নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের মৃত্যু না হয়; দুই-একজন সদস্য যাদের সীমা অতিক্রম করতে দেখা গেছে তারা বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছেন। নির্দেশনা থাকার পরও জুলাই আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করেনি বিজিবি। হাইকমান্ডের চাপ থাকার পরও বিজিবি কাউকে গ্রেপ্তার করেনি, এমনকি যৌথ বাহিনীর অভিযানেও গণগ্রেপ্তারে বিজিবি অংশগ্রহণ করেনি। বিজিবি কোথাও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেনি, বিজিবির বিশেষায়িত র্যাপিড অ্যাকশন টিম নামানো হয়নি, এমনকি এপিসি কিংবা পিকআপের ওপরে কোনো অস্ত্র স্থাপন করা হয়নি। এক অত্যুৎসাহী কর্মকর্তার অ্যাইমড শটের যে ছবি ভাইরাল হয়েছে, ঘটনার পরপরই তদন্ত সম্পন্ন করে তাকে মূল বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়।
বহু স্থানে আহত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে বিজিবি কর্তৃক আন্দোলন চলাকালীন চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তার নজিরও আছে। পিলখানার বর্ডার গার্ড হাসপাতালে এখন পর্যন্ত অসংখ্য গুরুতর আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অনেকের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এখনো চলছে। এমনকি ধানমন্ডির একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর আহত বেশ কয়েকজনের চিকিৎসা ব্যয়ও পরিশোধ করেছে বিজিবি। শতাধিক আহত ছাত্র-জনতাকে পুনর্বাসনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে নিভৃতে।
আরও একটি বাস্তবতা হলো ভুল শনাক্তকরণের ঝুঁঁকি। কয়েকটি বাহিনীর পোশাকের প্যাটার্ন কাছাকাছি হওয়ায় ঘটনাস্থলে কে কোথায় ছিল তা নির্ভুলভাবে চিহ্নিত না করে দায় চাপানো হয়তো সহজ, কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক নয়। হয়তো কোনো এক বাহিনীর পোশাক দেখে আন্দোলনকারীরা বিজিবি বলে মনে করেছে, দূর থেকে প্যাটার্ন চোখে ধরা পড়লেও কালার ও শেডের সামান্য পার্থক্য তাদের চোখে ধরা পড়েনি। যে কোনো প্রাণহানিই বেদনাদায়ক এবং দায় থাকলে তা অনুসন্ধানের মুখোমুখি হওয়া উচিত। তবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা অনুমাননির্ভর সংখ্যার ভিত্তিতে পুরো বাহিনীকে কালিমালিপ্ত ঘোষণা করা হলে মনোবল ভেঙে পড়ে, মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
লেখক : সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা