সরকার ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডকে আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আজকের মধ্যে পরিশোধ না করলে ১১ নভেম্বর থেকে কেন্দ্রটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আদানি পাওয়ার লিমিটেড বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) এরই মধ্যে এ সতর্কবার্তা দিয়েছে। ফলে হাতে মাত্র এক দিন সময় থাকলেও সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট আমদানিকৃত বিদ্যুতের একটি বড় অংশ আসে ভারতের এ বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে। এখন গড়ে ১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ আসে আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে দেশের জাতীয় গ্রিডে।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা বলেন, ‘আদানিকে বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের মধ্যে আলোচনা চলছে।’ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বলেন, ‘আদানির বকেয়া পরিশোধের ব্যাপারে সোমবার (আজ) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাব। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। যেহেতু আদানির বেঁধে দেওয়া সময় আরও এক দিন আছে, বিষয়টি আমরা দেখছি।’ বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ঝাড়খ রাজ্যে নির্মিত আদানির কয়লাভিত্তিক দুই ইউনিটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার। চুক্তি অনুযায়ী এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশের মতো আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসছে। এরই মধ্যে একাধিক দফায় অর্থ পরিশোধে দেরি হওয়ায় সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। একই কারণে গত বছর একবার বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করেছিল আদানি।
তবে বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে গত এক মাসে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ চাহিদা কমেছে। শীতের কারণে সামনে আরও চাহিদা কমে আসবে। যার কারণে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের হুমকির বিষয়টি নিয়ে সরকার তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।’
আদানি পাওয়ার লিমিটেডের ভাইস-চেয়ারম্যান অবিনাশ অনুরাগ গত ৩১ অক্টোবর বিপিডিবির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জানান, বিপিডিবি এখনো ৪৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়া পরিশোধ করেনি, যার মধ্যে ২৬২ মিলিয়ন ডলার বিপিডিবির নিজস্ব স্বীকৃত অপরিশোধিত বিল। যদি ১০ নভেম্বরের (আজ সোমবার) মধ্যে সব বকেয়া পরিশোধ করা না হয়, তাহলে আদানি পাওয়ার ১১ নভেম্বর (আগামীকাল মঙ্গলবার) থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
এর আগে, আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পাঠানো চিঠিতে ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধের আহ্বান জানান। তিনি জানান, জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ আংশিক অর্থ পরিশোধ করলেও এখনো একটি বড় অঙ্ক বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৩ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিপিডিবি কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বকেয়া ও লেট পেমেন্ট সারচার্জ (এলপিএস) পরিশোধ করা হবে, কিন্তু এখনো কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি দেওয়া হয়নি।
আদানির চুক্তি পর্যালোচনা করে গত ২ নভেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জাতীয় চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। এরপর মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কমিটির এক সদস্য জানান, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে। এদিকে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বিপিডিবির বিরোধ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। সিঙ্গাপুরের সালিশি আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে আদানি। বিষয়টির জন্য আদানির কাছে সময় চেয়েছে বিপিডিবি। বিপিডিবি সূত্র বলছে, আদানির সঙ্গে তাদের বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির প্রক্রিয়া তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এতে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। প্রমাণ সংগ্রহে আরও মাসখানেক সময় লাগবে।
জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আদানির চুক্তিতে দুর্নীতি তদন্তে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। জাতীয় চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি কাজ করছে। আদালতের নির্দেশনায় কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হবে। তাই এখন মধ্যস্থতার সুযোগ নেই, আদালত অবমাননা হতে পারে।