২০১০ সালে ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার ঠিক আগে আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলাম এবং দীর্ঘ অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সম্পন্ন করে সুস্থ হই। আজ ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে সেই ভোগান্তি আজও লাখ লাখ শিশুর নিত্যদিনের বাস্তবতা। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ দশমিক ৭ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হচ্ছে, যার মধ্যে প্রতি ১০ জন রোগীর ৭ জনই ১৫ বছরের কম বয়সি। টাইফয়েডের প্রকোপে প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। গত ১২ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোর সহায়তায় দেশব্যাপী ৫ কোটি ডোজ টাইফয়েড প্রতিরোধী টিকা বিনামূল্যে বিতরণের ঐতিহাসিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই টিকা কেবল আপনার সন্তানকে রক্ষা করবে না, বরং দেশ থেকে এই মারাত্মক ব্যাধিটি নির্মূল করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
শিশুস্বাস্থ্য ও টাইফয়েডের ঝুঁকি
টাইফয়েড জ্বর ‘সালমোনেলা টাইফি’ নামক ব্যাকটেরিয়াবাহিত একটি মারাত্মক রোগ, যা প্রধানত দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। যেসব শিশু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বা দুর্বল পয়োনিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত স্থানে বসবাস করে, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। রোগটি সাধারণ জ্বর ও পেটে ব্যথা দিয়ে শুরু হলেও, সঠিক চিকিৎসা না করা হলে বা অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স অসম্পূর্ণ থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। অন্ত্রে ছিদ্র (ইন্টেস্টাইনাল পারফোরেশন), গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তক্ষরণ এবং বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকলের (মাল্টি-অর্গান ফেইলিওর) মতো প্রাণঘাতী জটিলতা দেখা দিতে পারে। আক্রান্ত শিশুরা দীর্ঘ সময় স্কুলে অনুপস্থিত থাকে এবং অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার পরও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগতে পারে, যা তাদের পরিবারের ওপর আর্থিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স : বর্তমান বাস্তবতা
টাইফয়েড আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে অভিভাবকদের অসহায়ত্বও অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ‘ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট’ বা ওষুধপ্রতিরোধী টাইফয়েডের আবির্ভাবে চিকিৎসা জটিলতর হয়েছে। ওষুধপ্রতিরোধী টাইফয়েড প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকে ধ্বংস হয় না। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়াকে দিন দিন শক্তিশালী করে তুলছে। বর্তমানে এস. টাইফি ব্যাকটেরিয়ার প্রায় শতভাগ নমুনাই ফ্লুরোকুইনোলোনের মতো বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এই ওষুধগুলো এখন আর কার্যকর নয়। এমনকি শেষ ধাপের চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত সেফট্রিয়াক্সোন-প্রতিরোধী স্ট্রেনের আবির্ভাবে কার্যকর বিকল্প ওষুধের সংখ্যা কমে যাওয়ায়, আপনার সন্তানকে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আপনি কেবল তাকে একটি মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করছেন না, বরং গোটা জাতির স্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলা ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধেও সহায়তা করছেন। ফলে এটা অবশ্য করণীয়।
গুজব নয়, বিশ্বাস রাখুন বিশেষজ্ঞ অভিমতে
শিশুস্বাস্থ্যে টাইফয়েডের ঝুঁকি গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও চলমান টিকাদান কর্মসূচির ব্যাপারে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটানো হচ্ছে যে এই টিকা মেয়েদের বন্ধ্যত্ব বা ছেলেদের পুরুষত্বহীনতা ঘটাতে পারে, অথবা এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষক এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে নিশ্চিত করেছেন যে এই দাবিগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কলেরা এবং কভিড-১৯ টিকাদান অভিযানের সময়ও একই ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছিল। পরে যেগুলো ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। টাইফয়েড কর্মসূচিতে ব্যবহৃত ‘টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন’ হলো একটি একক-ডোজের, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত নিরাপদ এবং কার্যকর টিকা। এটি বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না এবং এটি সৌদি হালাল সেন্টার দ্বারা প্রত্যয়িত। স্থানীয় গবেষণায় এর কার্যকারিতার হার ৮৫ ভাগ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে। সামান্যতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন হালকা জ্বর বা ইনজেকশনস্থলে সাময়িক ব্যথা, একটি প্রাণঘাতী রোগ থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছরের সুরক্ষার তুলনায় নিতান্তই সামান্য এবং সহনীয়। ভয় বা মিথ্যা তথ্যের প্রভাবে আপনার সন্তানের জীবনকে কিছুতেই ঝুঁকিতে ফেলবেন না। সেটা একটা মারাত্মক আত্মবঞ্চনা হবে।
আর নয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব : এখনই টিকা দিন, শিশুর জীবন বাঁচান
১৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই টিকাদান কর্মসূচি চলবে। এটি একটি সমন্বিত, দেশব্যাপী প্রচেষ্টা, যার লক্ষ্য ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি প্রতিটি শিশুকে টিকার আওতায় আনা। টিকা প্রদানের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদেরও কোনো প্রয়োজন নেই। টাইফয়েড টিকা নিরাপদ, কার্যকর এবং এখন আগের চেয়েও বেশি জরুরি। ১৩ নভেম্বরের মধ্যে আপনার সন্তান যেন অবশ্যই টিকাটি পায়, তা নিশ্চিত করুন।
লেখক : এমবিবিএস (ডিইউ) শিক্ষার্থী, ইয়েল স্কুল অব পাবলিক হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র