ইসলাম একটি মানবিক জীবনব্যবস্থা। যার মূল ভিত্তি হচ্ছে ন্যায়, শান্তি, মানবিক মর্যাদা ও পারস্পরিক সহনশীলতা। ধর্মীয় সহাবস্থান বা সহনশীলতা ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা। ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয়; বরং সমগ্র মানবতার জন্য এসেছে। তাই বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কীভাবে হবে- এ বিষয়ে ইসলাম সুস্পষ্ট ও মানবিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে ইসলামের এ শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য ইসলামের প্রথম ভিত্তি হলো কোরআনের মূলনীতি। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সুরা বাকারা- ২৫৬) এ আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে, ইসলাম কখনো কাউকে জোর করে ধর্ম গ্রহণ করাতে অনুমতি দেয় না।
প্রত্যেক মানুষ নিজের বিশ্বাস নিয়ে স্বাধীন- এটি ইসলামি নৈতিকতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আরেক স্থানে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আর আমার ধর্ম আমার জন্য’। (সুরা কাফিরুন) এই ঘোষণা কেবল মতবিরোধ প্রকাশ নয়, বরং পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার স্বীকার করার নির্দেশনা। ইবাদত ও ধর্মীয় বিষয়ে কোরআন মানুষের মতভেদের বাস্তবতাকে স্বাভাবিক বলে ব্যাখ্যা করে এবং মতভেদ থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার প্রতি উৎসাহ দেয়। রসুলুল্লাহ (সা.) এর গোটা জীবন ধর্মীয় সহনশীলতার বাস্তব উদাহরণ, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি শুধু কথায় নয়, বাস্তব আচরণে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি দয়া, সহমর্মিতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ধর্মীয় সহনশীলতায় মহানবী (সা.) অসংখ্য নজির স্থাপন করেছেন। নিচে অংশবিশেষ উল্লেখ করা হলো,
১. মদিনা সনদ : মদিনায় হিজরতের পর মুসলমান, ইহুদি, মুশরিক অন্যান্য গোষ্ঠীকে নিয়ে রসুলুল্লাহ (সা.) একটি চুক্তি করেন যাকে মদিনা সনদ বলা হয়। এতে প্রতিটি ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। এটি বিশ্বের প্রথম বহুধর্মী রাষ্ট্রের সংবিধান হিসেবেও পরিচিত।
২. অসুস্থ ইহুদির জিয়ারত করা : এক ইহুদি কিশোর অসুস্থ হলে রসুলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। এটি মানবিকতা ও সহনশীলতার এক রহমতপূর্ণ উদাহরণ।
৩. খ্রিস্টানদের সঙ্গে সংলাপ : নজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মসজিদে নববীতে এসে আলোচনার আবেদন করলে রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের সঙ্গে মসজিদের ভিতরে সংলাপে বসেন। তারা নিজেদের উপাসনা করার অনুমতি চাইলে রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের উপাসনার অনুমতিও দেন। এটি ধর্মীয় স্বাধীনতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।
৪. ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর জানাজা দেখলে সম্মান প্রদর্শন : একবার এক ইহুদির মৃতদেহ রসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশর্^ দিয়ে বহন করা হলে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানসূচকভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন। সাহাবারা কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এটা কি মানুষের প্রাণ নয়?’ এতে জানা যায়, ইসলাম ধর্মে মানুষের মর্যাদা ধর্মনির্বিশেষে সমান।
৫. ইসলামি আইনে অমুসলিদের অধিকার : ইসলামের ইতিহাসে ‘জিম্মি’ বা অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের অনন্য দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তাদের ধর্ম, উপাসনালয়, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা মুসলমানদের মতোই ন্যায্য বিচারের অধিকারী।
খলিফা উমর (রা.)-এর আমলে এক বৃদ্ধ অমুসলিম ভিক্ষুক দেখলে তিনি রাষ্ট্র খাত থেকে তার জীবিকা নিশ্চিত করেন এবং বলেন, আমরা তার যৌবনে তার থেকে কর নিলাম; বার্ধক্যে তাকে পরিত্যাগ করা ন্যায়সংগত নয়। ইসলামের এই আদর্শ মানবতার সর্বোত্তম চিত্র।
৬. ঐতিহাসিক অবদান : ইসলামের সোনালি যুগে ধর্মীয় সহনশীলতার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
আন্দালুস (স্পেন) : মুসলিম শাসনামলে খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমানরা একত্রে জ্ঞানচর্চা, প্রশাসন এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে কাজ করত। এমন বহু ক্ষেত্রে ইসলাম সহাবস্থানের অসংখ্য নজির রেখেছে।
উসমানীয় সাম্রাজ্য : এ সাম্রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেদের আইন অনুযায়ী জীবনযাপন করত।
ভারতীয় উপমহাদেশ : মুসলমান শাসকরা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ও সংস্কৃতি রক্ষায় সহযোগিতা করেছেন। বাদশা আকবর তাঁর শাসনামলে ন্যায়নীতি ও ধর্মীয় সহাবস্থানের অভূতপূর্ব উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন।
আধুনিক বিশ্বে ইসলামের সহনশীলতার গুরুত্ব : আজকের বিশ্বে ধর্মীয় বিদ্বেষ, উগ্রতা ও সংঘাত যখন বাড়ছে, তখন ইসলামি সহনশীলতা মানবতার জন্য এক আদর্শ পথ দেখায়। ইসলাম বলে, মানুষকে দাওয়াত দাও জ্ঞান ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে। কোনো রকম বিদ্বেষ, বৈরিতা বা জোরজবরদস্তি ইসলামের শিক্ষা নয়।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা